আল্লাহর আযাবে মুসলমান কেন মরে?

তিনটা পয়েন্টে আলোচনাটা শেষ করব।

প্রথমত,

আমরা দেখলাম আল্লাহর আযাব-গযবের এপিসেন্টার হল স্পর্ধা। কাফির চিরকালই স্পর্ধা দেখিয়েছে, দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সে আল্লাহকে চেনে না। কিন্তু কাফিরদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা মুসলিমরা গত এক শতক পুরো উম্মাহ মিলে যে স্পর্ধা দেখিয়েছি, আগের ১৩০০ বছরে এতখানি ঔদ্ধত্য মুসলিমরা দেখায়নি। ইজতিমায়ীভাবে, সমষ্টিগতভাবে। আমি তো মনে করি, কাফিরদের তুলনায় আমরাই আল্লাহর গযবের বেশি উপযুক্ত। কী সে স্পর্ধা, সেটা একটু পরে একসাথে আলোচনা করছি।

দ্বিতীয়ত,

আল্লাহর আযাবের কিছু নিয়ম আছে। যখন দুনিয়ায় আযাব আসে, সেটা সবার জন্যই আসে। ইমাম মাহদীর বিরুদ্ধে প্রেরিত বাহিনীকে বাইদা নামক জায়গায় ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, শুনে আম্মাজান আইশা রা. জিগ্যেস করেন: বাইদা এলাকায় এমন অনেক লোকও তো থাকতে পারে, যারা বাহিনীর লোক না। বাজার এলাকার আম পাবলিক। তারাও এই আযাব ভোগ করবে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: হ্যাঁ, যখন কোনো এলাকায় আল্লাহর আযাব আসে, তখন সবার উপরই আসে। পরে হাশরের মাঠে যার যার নিয়ত অনুসারে আলাদা হয়ে যাবে।

বিশেষ করে মহামারি সম্পর্কে নবীজী স্পষ্ট করেই বলেছেন: "মহামারি হল রিজয (গযব বা শাস্তি) বা আযাব, যা আল্লাহ বনী ইসরাঈল বা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেদের উপর দিয়েছিলেন। কতক জাতিকে এর দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিছু এখনও বাকি রয়ে গেছে, তাই কখনও তা আসে, কখনও চলে যায়। তবে মুমিনদের জন্য আল্লাহ একে রহমত বানিয়েছেন। যদি মুমিন ধৈর্য সহকারে নিজ শহরে অবস্থান করে, মৃত্যু হলে সে শহীদের সমান সওয়াব পাবে"।

তৃতীয়ত,

মুসলিমদের উপর একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল। মানুষকে আল্লাহ জমিনে তাঁর খলীফা/প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের কাছে এভাবেই তিনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন: 'আমি জমিনে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব'। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। তার দায়িত্ব আল্লাহর ক্যানভাস করা (যেভাবে রাষ্ট্রদূত তার দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন) এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর বিধানমাফিক দুনিয়া শাসন করা। মানুষের মধ্যে যারা আল্লাহর পরিচয় ভুলে 'ভুল উপাস্য' নিয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব, সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানে না। আর যারা আল্লাহকে তাঁর প্রকৃত পরিচয়ে চিনেছে তারা হলাম আমরা, মুসলিম। সুতরাং প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব এককভাবে আমাদের। দায়িত্ব কী ছিল? আল্লাহর দাওয়াহ এবং আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ। আল্লাহর বিধানের দিকে আহ্বান ও আল্লাহর বিধান লংঘনকারীদের রোধ। যার স্তর তিনটি:

- হাত দ্বারা (জি.হাদ বলে একে। এর কনসেপ্ট নিয়ে মুসলিমদের মাঝে বহু ভুল ধারণা আছে। এটাও আমরা পরে আলোচনায় আনবো ইনশাআল্লাহ)। না পারলে...
- জবান দ্বারা (দাওয়াহ)। না পারলে...
- অন্তর দ্বারা (বুগদ ফিল্লাহ/ঘৃণা)। নবীজী বলেছেন, এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। জোর করে বা মৌখিক বাধা দিচ্ছেন না, ওকে ফাইন।আল্লাহর বিধান লংঘনকে যদি কমপক্ষে ঘৃণাও করতে না পারেন, তাহলে খুব সম্ভব আল্লাহর খাতায় মুসলিম তালিকায় আপনার নাম আর নেই।

এই 'আদি দায়িত্ব'-এ অবহেলার কারণে মুমিনদের প্রতিই আল্লাহর আযাব আসে।

এক জনপদের উপর আযাব পাঠানো হল। ফেরেশতারা ফিরে এসে জানাল: সেখানে এমন এক বুজুর্গ আছেন, যে এক মুহূর্তও আপনাকে ভোলেনা। আল্লাহ বললেন: তাকে আগে উল্টে দাও, এরপর জনপদ উল্টাও। কারণ কি? কারণ হল, তার চারিপাশে পাপ-জুলমে সয়লাব, আর তার ভ্রুও কুঞ্চিত হয়নি। তার অন্তরে খারাপও লাগেনি। সর্বনিম্ন স্তরের দায়িত্বও সে পালন করেনি।

আমাদের দায়িত্ব ছিল ইসলামের এই বার্তা, ইসলামের এই সুশাসনের আওতায় সকল মজলুমকে নিয়ে আসা। যাতে মানবতার মুক্তি ঘটে। সব সামাজিক (দলিত / নিগ্রো / হিজড়া / হিন্দু বিধবা প্রথা / পেশাগত হীনম্মন্যতা) মজলুম, সব অর্থনৈতিক মজলুম, রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের মজলুম, পুঁজিবাদের মজলুম, ক্যারিয়ারিজমের মজলুম সবার কাছে ইসলামের সমাধান পৌঁছে দেয়া এবং ইসলামের সিস্টেমের ভিতর এনে এই নিগৃহীত মানবতাকে স্বস্তি দেয়া ছিল আমাদের কাজ। জালেম নিজেও জুলুমের মধ্য দিয়ে নিজের উপরেও জুলুম করে। জালেমকে জুলম থেকে ফিরানো মানে খোদ তার উপরও এহসান। পুরো উম্মাহ আমরা একসাথে সেই 'আদি দায়িত্ব' ছেড়ে দিয়েছি।

গুনাহকে ঘৃণা করা তো দূর কি বাত। ঘৃণা করবার আগে সেটাকে গুনাহ তো মনে করতে হবে আগে। গুনাহকে গুনাহ মনে করাই ছেড়ে দিয়েছি মুসলিমরা। বহু মুসলিম আমরা মিউজিককে গুনাহ মনে করি না, অথচ নবীজী মিউজিক শুনলে কানে আঙুল দিয়ে সে জায়গা পার হতেন। বলেও গেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন দল বের হবে যারা ব্যভিচার-রেশম-মদ-বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে [বুখারী]। বলেছেন: আল্লাহ আমার উম্মতের উপর মদ-জুয়া-বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন [মিশকাত সহীহ]। অথচ বহু মুসলিমকে আপনি বোঝাতে পারবেন না। তারা একে ঘৃণা তো দূরের কথা, হারামই মনে করবে না। নিষেধ করাকে উগ্রতা মনে করবে। তার মানে নবীজী 'উগ্র' ছিলেন? নাউযুবিল্লাহ।

বহু মুসলিম ঘুষ-সুদকে 'ও-কিছু-না' মনে করে। বহু মুসলিমা পর্দা করাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে, মাহরাম- ননমাহরাম মেনে চলাকে বাড়াবাড়ি মনে করে। ছেলেরা মেয়েদের দিকে তাকানোকে গুনাহ মনে করে না, অথচ তা সূরা নূরে আল্লাহ নিজে আদেশ করেছেন। বহু দীনদার পর্দানশীন মুসলিমা পুরুষের দিকে তাকানোকে তেমন কিছু গণ্য করে না, অথচ তা আল্লাহর আদেশ।

আল্লাহর কসম, ইসলামের ইতিহাসে এমন সময় কোনোদিন আসেনি যে, এতো বেশি সংখ্যক মুসলিম কুরআন-হাদিসে বর্ণিত স্পষ্ট অকাট্য সব হুকুমকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহর আদেশকে অদরকারি মনে করেছে। আল্লাহর আদেশকে ইনিয়ে বিনিয়ে অজুহাতসহ বা স্পষ্টভাবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এমন ঔদ্ধত্য সামষ্টিকভাবে মুসলিমরা আগে কোনোদিন দেখায়নি। ক্যারিয়ার, আধুনিকতা, সামাজিকতা, মধ্যপন্থা- ইত্যাদির অজুহাতে আর-রাজ্জাক আল-মালিকের আদেশের প্রতি এতোটা তাচ্ছিল্য আমরা আগে কখনও দেখাইনি। এমনকি এই পোস্ট পড়তে পড়তেও অনেক মুসলিম ভাইয়ের মনে নেগেটিভ অনুভূতি হচ্ছে। কী ভয়ংকর স্পর্ধা আমরা দেখাচ্ছি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সাথে। সামনে আরও বিস্তারিত আসবে বিষয়গুলো। মোদ্দাকথা সৎকাজে আদেশ আর অসৎকাজে নিষেধ করার 'আদি-কর্তব্য'তে অবহেলা আল্লাহর গযবের আরেকটি কারণ।

সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়।

"বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যা কে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না"। [ সুরা তাওবা ৯:২৪ ]

যদি ৮টা জিনিস বেশি প্রিয় হয় ৩টা জিনিসের চেয়ে, তাহলে অপেক্ষা কর আযাবের। আমাদের মুসলিমদেরই উদ্দেশ্যে আয়াতটা।

উপরের তিনটির প্রতিটি আমরা মুসলিমরা পূর্ণ করেছি। আযাব যখন আসে, সেটা ব্যাপকভাবে আসে। সবার জন্য আসে। কারও জন্য পাকড়াও, আর কারও জন্য সতর্কবাণী। আশ্চর্য আমরা আযাবকে আযাব বলতেই লজ্জা পাই, তাহলে সতর্ক হব কীভাবে। আর আযাবে যদি সতর্ক না হতে পারি তাহলে? 'বড় আযাবের আগে আমি তাদের ছোট আযাব আস্বাদন করাই, যাতে তারা ফিরে আসে' (আয়াত)। ছোট আযাব টের পেতে ব্যর্থ হলে, আমার জন্য এরপরের আপ্যায়ন কেমন হবে? বড় আযাব। জাহান্নাম।

আফসোস, মুসলিমসন্তানের কাছে আজ জাহান্নামও মামুলি ব্যাপার। মুসলিম হয়ে যেহেতু জন্মেছি, সাজা খেটে একদিন তো জান্নাতে যাবোই। আল্লাহর খাতায় আমি এখনও মুসলিম আছি, সিওর? আল্লাহর অকাট্য হুকুম অস্বীকার করলে ঈমান থাকে না, মানতে পারছি না, ভিন্ন বিষয়। দেখেন তো ভেবে আল্লাহর কী কী হুকুম আমার পছন্দ হয় না। কী দরকার ছিল এই বিধানের। কোন কোন বিধান মনে হয় 'এ যুগে কী আর ওসব চলে'। এমন না হয়ে ওমন হলে ভালো হত। ওযুভঙ্গের কারণ যেমন আছে, ঈমানভঙ্গেরও কারণ আছে। ক'জন জানি? আমার অজান্তেই ঈমান হারিয়ে বসে নেই তো আমি? ইয়া আল্লাহ, আমি জানতাম না, তাই ওমন বলে ফেলেছি। 'না জানা' -কে আল্লাহ কাল হাশরে কোনো ওজর হিসেবে গ্রহণ করবেন না। আমার কাছে আলেম ছিল, মসজিদে ইমাম ছিল, নেট ছিল, হাজারও পিডিএফ ছিল, দীনী বন্ধু ছিল। আমার জানতে ইচ্ছে হয়নি, তাই জানিনি। জানা প্রয়োজন মনে করিনি, তাই জানিনি। না জানাটা আরেকটা ফরজ হুকুমের তোয়াক্কা না করা। জানাও ফরজ ছিল আমার উপর। সেদিন আর কাকে দোষ দেব, যেদিন খোদ শয়তানও বলবে: "খবরদার আমাকে দুষবে না, আমি কিচ্ছু করিনি। আমি কেবল রাস্তা দেখিয়েছি। গুনাহের রাস্তায় তুমি নিজেই হেঁটেছো"। (আয়াত)

আল্লাহর এই গযব আমি মনে করি আমাদের উদ্দেশ্যে। আমাদেরকে সতর্ক করতে। আমাদের পাপের ভারা পূর্ণ। আমাদের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, স্পর্ধা আর কাফিরপ্রেম চূড়ায় পৌঁছে গেছে। ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছি আমরা।

চলবে ইনশাআল্লাহ


ঈমানভঙ্গের কারণগুলো এখানে সংক্ষেপে দেখে নিতে পারেন: উস্তাদ মুনীরুল ইসলাম ইবনে যাকির সংকলিত