১২। সূরা ইউসুফ, আয়াত ৫৩ থেকে ১১১
ইউসুফ (আঃ) সাক্ষ্য দেন যে দুর্বল মুহূর্তে আল্লাহই তাঁকে খারাপ কাজে প্রলুব্ধ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন, তাঁর নিজের কৃতিত্ব নেই।
মিসরের বাদশাহ ইউসুফ (আঃ)-কে অর্থমন্ত্রী তথা 'আযীযে'র পদে ভূষিত করেন। এভাবে এক কালে সব হারানো ইউসুফকে আল্লাহ মহাসম্মানের স্থানে তুলে নেন।
দুর্ভিক্ষ শুরু হলে রেশনের জন্য ইউসুফের ভাইয়েরা এলো। ইউসুফ তাদের চিনলেন, তারা তাঁকে চিনতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককে উট বোঝাই মালসামানা দেওয়া হলো। পিতার দেখভালের জন্য ঘরে থাকা বিন ইয়ামীনের জন্যও তারা সামানা চাইল। ইউসুফ (আঃ) বললেন ভাইকে সাথে করে আবার আসতে। নাহয় পরবর্তীবার তাদের কিছু দেওয়া হবে না।
ভাইয়েরা হতাশ হয়ে ফিরে গিয়ে ইয়াকুবকে (আঃ) বললো বিন ইয়ামীনকেও তাদের সাথে পাঠাতে। কিন্তু ইউসুফের সাথে ইতোপূর্বে তারা যা করেছে সেজন্য ইয়াকুব (আঃ) ভরসা পেলেন না। ভাইয়েরা তাদের মালপত্রে হাত দিয়ে দেখল রেশন আনার জন্য তারা যেসব পণ্য নিয়ে গিয়েছিল (তখন পণ্য বিনিময় প্রথা ছিল), তা তাদের অজান্তে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পরেরবার আবার সেগুলো নিয়ে যেতে পারে। তা দেখিয়ে তারা পিতাকে ভরসা দিল। কথা দিল এইবার নিরাপত্তার কোনো ব্যত্যয় করবে না। ইয়াকুব (আঃ) অনুমতি দিলেন। তাদের বললেন শহরের আলাদা আলাদা ফটক দিয়ে ঢুকতে। কারণ এগার ভাইয়ের দলকে দেখলে কারো বদনজর লাগতে পারে। তবে এ-ও বলে দেন যে, বদনজর থেকে বাঁচানোর মালিক তো কেবল আল্লাহই।
বিন ইয়ামীন সহ তারা মিশরে গেলে ইউসুফ (আঃ) তাঁর ভাইকে নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা করলেন। একটি রাজকীয় পানপাত্র গোপনে তিনি বিন ইয়ামীনের সামানার সাথে রেখে দিলেন। পানপাত্র হারানোর খবর চাউর হওয়ার পর লোকেরা ইউসুফের ভাইদের চোর সাব্যস্ত করল। তারা অস্বীকার করল। জিজ্ঞেস করা হলো তাদের কাছে চুরির মাল পাওয়া গেলে কী করা হবে। তারা ইয়াকুব (আঃ) এর শরিয়ত অনুযায়ী বলল যে শুধু চোরকে পণ্যের মালিক বন্দী করে রাখবে, বাকিদের ছেড়ে দিবে (মিশরের রাজার আইন/শরিয়ত অনুযায়ী এত সহজে ইউসুফ ভাইকে নিজের কাছে রাখতে পারতেন না)। তল্লাশীর পর বিন ইয়ামীনের সামানার ভেতর পানপাত্রটি পাওয়া গেল। অন্য ভাইয়েরা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলল, তার ভাইও (ইউসুফ) তো এরকম একবার চুরি করেছিল। ইউসুফ (আঃ) তাদের কিছু বললেন না।
পিতার কাছে এত কঠিন প্রতিজ্ঞা করার পর বিন ইয়ামীনকে ছাড়া ফিরতে সংকোচ লাগায় ভাইদের মাঝে সবার বড়জন মিশরে থেকে যায়। বাকিরা গিয়ে ইয়াকুব (আঃ)-কে সব ঘটনা জানায়। ইয়াকুব (আঃ) কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান। অতঃপর ছেলেদের বলেন ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সন্ধান করতে, আশা না হারাতে। আল্লাহর রহমত থেকে কাফিররাই কেবল হতাশ হয়।
ভাইয়েরা আবার মিশরে ফিরে গিয়ে মালসামানার জন্য অনুনয় করে। ইউসুফ (আঃ) তাদের সামনে নিজ পরিচয় প্রকাশ করেন। ভাইয়েরা অনুতপ্ত হয়। তিনি তাদের সকলকে ক্ষমা করে দেন। তিনি ভাইদের বলেন পিতামাতাকে সহ মিশরে নিয়ে আসতে। সাথে তিনি নিজের একটি জামা দেন, যা ইয়াকুব (আঃ) এর চোখে রাখলে আল্লাহর ইচ্ছায় মু’জিযাস্বরূপ চোখ ভালো হয়ে যাবে।
তারপর পিতামাতাকে সহ ভাইয়েরা সবাই ইউসুফ (আঃ) এর কাছে ফিরে আসে। ইউসুফ পিতামাতাকে সম্মানের আসনে বসান। তারা সকলে ইউসুফ (আঃ) এর সামনে সেজদা করেন, কারণ পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়তে এমন সম্মানসূচক সেজদা জায়েয ছিল। এভাবে সূরার শুরুতে ইউসুফ (আঃ) এর দেখা স্বপ্ন সত্যি হয়। ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানান।
পরিশেষে আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ) ও মুমিনদের সান্ত্বনা দেন। ইউসুফ (আঃ) এর মতোই দীর্ঘ সময়ে দুঃখকষ্টে থাকা লাগলেও মুমিনরা শেষমেশ জয়ীই হবে । কাফিররা যে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার পাশাপাশি শির্কও করে, তার তিরস্কার করা হয়। প্রতি যুগেই এমন হয়েছে যে নবীর শত্রুরা আযাব আসতে দেরি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিকই শেষ পর্যন্ত তারা ধ্বংস হয়েছে।
১৩। সূরা রা’দ
সূরা রা'দে আল্লাহর বিভিন্ন সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাওহীদের প্রমাণ দেখানো হয়েছে। খুঁটিবিহীন আসমান, চাঁদ, সূর্যের আবর্তন, বিস্তীর্ণ পৃথিবী, নদনদী, জোড়ায় জোড়ায় মাখলুক, পাশাপাশি অবস্থিত বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ড, উদ্ভিদবৈচিত্র্য সৃষ্টিকারীর জন্য আখিরাতে পুনরায় সৃষ্টি কঠিন কিছু নয়।
মাতৃগর্ভে যা বাড়েকমে, দিনেরাতে যে যা প্রকাশ্যে ও গোপনে বলে- সবই আল্লাহর জ্ঞানের আয়ত্তাধীন।
আল্লাহ বিজলি চমক দিয়ে আশা ও ভীতি উভয়ই প্রদর্শন করেন। বজ্রনির্ঘোষ ও ফেরেশতাগণ তাঁরই প্রশংসা করে।
আল্লাহ ছাড়া অন্য সৃষ্টির কাছে দু’আ করাটা যেন পানির নিকট দু’আ করার মতো, যাতে তা আপনাআপনিই মুখে চলে আসে। (এদিক দিয়ে মুশরিকদের মূর্তিপূজা ও নাস্তিকদের বস্তুপূজা একইরকম)
সকল কিছুই স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে।
বাতিল মতাদর্শ ফেনার মতো উপচে পড়া অস্থায়ী জিনিস। আর হক হলো জমিনে থেকে যাওয়া উপকারী ও স্থায়ী বস্তু।
আখিরাতে কাফিররা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের কয়েকগুণ মুক্তিপণ দিয়ে হলেও শাস্তি থেকে বাঁচতে চাইবে, কিন্তু তা সম্ভব হবে না।
মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষা করা, আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্কগুলো রক্ষা করা, সবর করা, সালাত কায়েম, আল্লাহর দেওয়া রিযক থেকে গোপন ও প্রকাশ্যে দান, দুর্ব্যবহারের বিপরীতে সদাচরণ করা। এরা আত্মীয়পরিজন সহ জান্নাতে যাবে। এর বিপরীতকারীরা জাহান্নামি।
আল্লাহর স্মরণেই (যিকর) অন্তরসমূহ প্রশান্তি পায়।
কাফিররা মু’জিযা দেখলে ঈমান আনবে বলে যে মিথ্যা দাবি করে, তার অসারতা দেখান হয়। মুমিনরাও ভাবত এসকল কাফিরের ওপর আযাব আসছে না কেন। বলা হয়, দুনিয়ায় তো এদের উপর ছোটখাটো বিপদ আসছেই, আর আখিরাতের শাস্তি তো আরো কঠিন। শির্ক কুফরের প্রতিপত্তি চারদিক থেকে সংকুচিত হয়ে আসছে।
মুশরিকরা মাটির মূর্তি বানিয়ে কল্পিত নাম আরোপ করে তার পূজা করে। আহলে কিতাবরা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ মানতে অস্বীকার করে। এ সকল প্রকার শির্ককে তিরস্কার করা হয়েছে।
১৪। সূরা ইবরাহীম
সূরা ইবরাহীমেও ইসলামের মৌলিক আকিদা বিশ্বাস আলোচিত হয়েছে। আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্যদানকারী ও দ্বীনের মাঝে বক্রতা অনুসন্ধানকারীদের তিরস্কার করা হয়েছে।
নূহের (আঃ) জাতি, আদ, সামূদ, ফিরআউনের অবাধ্যতা ও পরিণতির কথা স্মরণ করানো হয়েছে। তাদের কাছে প্রেরিত নবীগণও মানুষই ছিলেন। কাফিররা দুনিয়াতেও ধ্বংস হয়, ফলে ঈমানদাররা জমিনে প্রতিষ্ঠা পায়। জাহান্নামে কাফিরদের গলিত পুঁজ ভক্ষণ করানো হবে, পোশাক হবে আলকাতরার, মুখ আগুনে আচ্ছন্ন হবে। মৃত্যু তাদের চারদিক থেকে এগিয়ে আসবে, কিন্তু তারা মরবে না। তাদের দুনিয়ার সব ভালো কাজ ছাইয়ের মতো- যা ঝড়ে উড়ে গেছে, কোনো লাভ হয়নি।
কাফিররা তাদের নেতাদেরকে আখিরাতে বলবে তাদের জন্য কিছু করতে। নেতারা অপারগতা প্রকাশ করবে। তাদেরকে সুন্দর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে রাখা শয়তানও সেদিন তাদের থেকে দায়মুক্তি ঘোষণা করবে। সে তো কেবল ভ্রান্ত পথের দিকে ডেকেছিল, কাউকে জোর করেনি। আজ সেও কাউকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না, তাকেও কেউ বাঁচাবে না।
পবিত্র বাক্য বা কালিমা তাইয়্যিবাহ হলো পবিত্র গাছের মতো, যার মূল দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, ডালপালা আসমানে উত্থিত, প্রতিপালকের নির্দেশে অহরহ ফল দেয়। আর অপবিত্র বাক্য বা কুফরি কথাবার্তা হলো অপবিত্র গাছের মতো, যাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
সূর্য-চন্দ্র, নদী-নালা, যানবাহনকে আল্লাহ আমাদের অধীন করে দিয়েছেন যেন আমরা তাঁরই ইবাদাত করি।
ইবরাহীম (আঃ) এর বংশধর হিসেবে আরবরা গর্ব করত। অথচ তিনি শির্ক ও মূর্তিপূজা ঘৃণা করতেন, সন্তানরাও যাতে এ থেকে বেঁচে থাকে সেই দু’আ করেছেন। হাজেরা (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-কে তিনি আল্লাহর আদেশে এই ভূমিতে রেখে গেছেন যেন তারা সালাত কায়েম করে। তাই আল্লাহ এই বিরানভূমিতে তাঁদেরকে উত্তম রিযক দিয়েছেন। ইবরাহীম (আঃ) সকল মুমিনের মাগফিরাতের দু’আ করেন।
কিয়ামতের দিন কাফিররা আরেকটু অবকাশ চাইবে কিন্তু তাদের তা দেওয়া হবে না।