০৪। সূরা নিসা, আয়াত ৮৭ থেকে ১৭৬
মুনাফিকদের কেউ কেউ মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণের ভান করে আবার মক্কায় ফিরে গিয়ে কাফিরদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে সহায়তা করে। কেউ কেউ মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনো দুরভিসন্ধি পোষণ করে না। কেউ ভাব দেখায় যে যুদ্ধ করতে চায় না, কিন্তু কাফিরদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে ঠিকই তাদের সাহায্য করে। এমন প্রত্যেক শ্রেণীর ব্যাপারে করণীয় বিধান বর্ণনা করা হয়।
চুক্তিবদ্ধ জাতির কাছে আশ্রয় নেয়া এবং কোনো পক্ষের হয়েই যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করতে বলা হয়।
ভুলবশত কোনো মুসলিমকে হত্যা করার কাফফারার বিধান বলা হয়। ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে মুসলিম হত্যার শাস্তির কথা বলা হয়।
জিহাদের ময়দানে কোনো কাফির বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়, তারা জান বাঁচাতে মিথ্যা বলছে এমন ধারণা না করতে বলা হয়।
জিহাদ ফরজে কিফায়া থাকাকালীন কেউ কেউ বিনা ওজরে জিহাদে না গেলে দোষ নেই। তবুও ঘরে বসা লোকদের তুলনায় মুজাহিদদের মর্যাদা বেশি। হিজরত ফরজ হয়ে যাওয়ার পরও তা না করার ভয়াবহতা বর্ণিত হয়, তবে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের কথা আলাদা। জিহাদের মাঠে সালাত আদায় করার নিয়ম বর্ণিত হয়।
বিশর নামের এক মুনাফিক কিছু জিনিস চুরি করে এক নিরপরাধ ইহুদীকে ফাঁসায়। যদিও ওই ইহুদী বলে যে এসব জিনিস বিশর তাকে দিয়েছে, কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি। বিশরের গোত্রও তার পক্ষে ওকালতি করে। রাসূল (সাঃ) বিচার করার সময় আপাত প্রমাণের ভিত্তিতে ইহুদীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বিশরের মুখোশ উন্মোচন করেন। নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসানো, অপরাধীর পক্ষে ওকালতি করা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা ও এর ভয়াবহতা বর্ণিত হয়। এসব কাজ করে দুনিয়াতে পার পেয়ে গেলেও আখিরাতে শাস্তি হবে।
সুন্নাহ এবং মুসলিমদের ইজমাও যে শরিয়তের দলীল, এ সংক্রান্ত কিছু ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
শির্কের গুনাহ তাওবাহ ছাড়া মাফ হয় না। মুশরিকরা নারীদেরকে পুরুষদের চেয়ে নিকৃষ্ট ভাবে, অথচ ঠিকই নারীদেবীর উপাসনা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা শয়তানের উপাসনা করে। শয়তান ওয়াদা করেছিলো যে সে তার অনুসারীদের অনেক আশা ভরসা দেবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধনে প্ররোচিত করবে।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৎকর্মশীল ঈমানদারদের জন্য জান্নাতের লোভনীয় বর্ণনা দেওয়া হয়।
ইয়াতীম নারীর দেখভাল, স্ত্রীদের মাঝে সমতাবিধানের স্বরূপ, স্বামী-স্ত্রীর মীমাংসা, বিরোধ ও বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণিত হয়।
মুমিনদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের বিদ্বেষের কথা উন্মোচন করে তাদের সাথে ওঠাবসা-চলাফেরার বিধান বর্ণনা করা হয়। মুনাফিকদের স্থান জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে, তবে তাওবাহকারীদের কথা আলাদা।
অন্যের দোষ চর্চা নিষেধ করা হয়, তবে জুলুমের বিচার করার জন্য এমন করা হলে ভিন্ন কথা। ক্ষমা করার মানসিকতাকে উৎসাহিত করা হয়।
কিছু নবীর প্রতি ঈমান আনা আর অন্য কোনো নবীকে অস্বীকার করা পুরোটাই কুফরি।
আহলে কিতাবরা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে দাবি করে আসমান থেকে একটি কিতাব নামিয়ে এনে প্রমাণ দেখাতে। আল্লাহ এর জবাবে স্মরণ করিয়ে দেন যে, যেই মূসা (আঃ) এর ওপর তারা ঈমান আনার দাবি করে, তাঁর কাছে এরা এর চেয়ে গুরুতর দাবি করেছিলো। বলেছিলো আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখাতে। এর শাস্তিস্বরূপ তাদের ওপর বজ্র আঘাত হানে, তূর পাহাড়কে তাদের মাথার ওপর তুলে ধরা হয়। এছাড়া বাছুরপূজা, শনিবারের আইন লঙ্ঘন, অহংকার করা, নবীদের হত্যা করা, মারইয়াম (আঃ)-কে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া ইত্যাদি কুকাজে তারা লিপ্ত ছিলো। ঈসা (আঃ) এর শূলবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে তারা নিজেরাই নিশ্চিত না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাঁকে জীবিত আসমানে তুলে নেন। কিয়ামাতের আগে ঈসা (আঃ) এর পুনরাগমন দেখে সব আহলে কিতাব এই বাস্তবতার ওপর ঈমান আনতে বাধ্য হবে। আর কিয়ামতের দিন ঈসা (আঃ) ঐসকল কুফরিকারীদের বিপক্ষে সাক্ষী হবেন। বনী ইসরাইলীদের এসব হঠকারিতার মূল্যস্বরূপ তাদের শরিয়তে অনেক বস্তু হারাম ছিল। তাদের মধ্যকার কাফির পাপাচারীদের শাস্তি ও মুমিন নেককারদের পুরষ্কারের কথা বলা হয়।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সত্য নবী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ সাক্ষ্য দেন, যেমন সত্য ছিলেন পূর্বেকার সকল নবী যারা সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে আগমন করেছেন। খ্রিষ্টানদের ট্রিনিটির (ত্রিত্ববাদ) বিশ্বাসকে খণ্ডন করে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া হয়। ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র ভাবার একটা কারণ হলো আল্লাহর বান্দা হওয়াটাকে তারা ঈসা (আঃ) এর মর্যাদার পরিপন্থী ভাবতো। অথচ ঈসা (আঃ) নিজেকে আল্লাহর বান্দা ভাবতে মোটেও লজ্জা পেতেন না।
পিতা, দাদা, পুত্র ও পৌত্র না থাকা অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত হয়েছে।
০৫। সূরা মায়িদাহ, আয়াত ১ থেকে ৮২
সূরা মায়িদাহ এর শুরুতে হালাল-হারাম খাদ্য, শিকার, হাজ্জের ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার, আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ করা, ওজু, গোসল, তায়াম্মুমের নিয়ম বর্ণিত হয়। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করতে বলা হয়।
ইহুদী ও নাসারা উভয় সম্প্রদায় তাদের কিতাবের অনেক বিষয় গোপন করত যা আল্লাহ রাসূলের (সাঃ) মুখ দিয়ে প্রকাশ করিয়ে দেন। এই নিদর্শনের কথা বলে তাদেরকে এই নবীর প্রতি ঈমান আনতে বলা হয়। এসকল লোক নিজেদের আল্লাহর সন্তান দাবি করে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে যে তারা আল্লাহর আযাবের শিকার হচ্ছে, তাও স্বীকার করে। আল্লাহ এই দ্বিমুখী বিশ্বাসের ত্রুটি তুলে ধরেন। ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর সন্তান বলে মনে করার জঘন্য বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়।
মূসা (আঃ) বনী ইসারইলকে নিয়ে প্রতিশ্রুত ভূমির (শাম ও ফিলিস্তিন) প্রান্তে এসে তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে বলেন। এতদিন এই ভূমির অপেক্ষায় থাকা বনী ইসরাইল এখন বলে ওঠে যে ওখানে অনেক শক্তিশালী জাতি থাকে, ওরা বের হয় গেলে পরে আমরা ঢুকব। মাত্র দুজন নেককার ব্যক্তি মূসা (আঃ) এর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে অগ্রসর হতে রাজি হন। বনী ইসরাইলীরা মূসা (আঃ)-কে ধৃষ্টতা সহকারে বলে- আপনি আর আপনার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করেন, আমরা এখানে বসলাম। এর শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদের ৪০ বছরের জন্য এ ভূমি থেকে দূরে রাখেন। ফলে জাতিটি এদিক সেদিক দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকে। জিহাদের হুকুম আসার পরও গা বাঁচানো মানসিকতার ফলে এই শাস্তি হয়।
মানবহত্যার ভয়াবহতা দেখানোর জন্য হাবিল ও কাবিলের ঘটনা বর্ণিত হয়। আত্মরক্ষা করা জায়েয হলেও হাবিল তাকওয়ার কারণে কাবিলকে কোনো বাধা দেননি। আল্লাহর হুকুমে একটি কাক এসে লাশ কবর দেওয়ার নিয়ম দেখিয়ে দেয়, কারণ এটি মানব ইতিহাসের প্রথম খুন, এমনকি প্রথম মৃত্যু। কাবিল আফসোস করে যে সে কাকটির মতোও বিচক্ষণ হতে পারল না। আল্লাহ হুকুম জারি করেন যে একটি নিরপরাধ প্রাণ হত্যা করা যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার শামিল। আর একটি নিরপরাধ প্রাণ বাঁচানো সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচানোর শামিল। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) বিরুদ্ধাচরণ ও জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি (ডাকাতি এর অন্তর্ভুক্ত) করলে কী শাস্তি হবে, তা বিস্তারিত বলা হয়। কয়েক আয়াত পর চুরির শাস্তিও বর্ণিত হয়। তবে তওবা করে সুপথে চললে ক্ষমার সুসংবাদও দেয়া হয়।
ইয়াহুদীরা তাওরাতের আইনগত শাস্তির বিধানগুলো পরিবর্তন করত। গরীবদেরকে শাস্তি দিত, ধনী কেউ অপরাধ করলে শাস্তি হালকা করে দিত। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে বিচার চাইতে আসলে তাঁর শরিয়ত অনুযায়ী হালকা শাস্তি পাওয়া যাবে, এমন আশায় তাঁর কাছেও মামলা মোকদ্দমা নিয়ে আসত। কিন্তু যেসব বিধান এই শরিয়তেও একইরকম, সেসব ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) একইরকম শাস্তির বিধানই দিতেন। ইয়াহুদীরা আগেই ঠিক করে আসত কোন কোন রায় দিলে তারা মানবে, আর কোন কোন রায় মানবে না। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয় যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিচার ফায়সালা করে না তারা কাফির, জালিম, ফাসিক।
ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু বানাতে নিষেধ করা হয়। ইসলামের বিরুদ্ধে তারাই একে অপরের বন্ধু। মুনাফিকরা তাদের শক্তিমত্তা দেখে তাদের সাথে যোগ দেয়। আল্লাহ ইসলামকে বিজয় দেওয়ার পর এরা বিপদে পড়ে যাবে।
ঈমান আনার পর তা থেকে বিমুখ হলে আল্লাহ তাঁর প্রিয় ঈমানদার বান্দাদের অন্য কোনো দলের মাধ্যমে ইসলামের খেদমত করিয়ে নেবেন। মুমিনদের প্রতি কোমল হতে, কাফিরদের প্রতি কঠোর হতে, জিহাদ করতে এবং এ ব্যাপারে নিন্দুকদের পরোয়া না করতে হুকুম করা হয়।
দ্বীন নিয়ে আহলে কিতাবদের ঠাট্টা মশকরা করাকে তিরস্কার করা হয়। তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদের সাময়িক কষ্টে ফেলেন। এতে তারা বাধ্য না হয়ে উল্টো বলে বসে “আল্লাহ কৃপণ।” তাদের ওলামা মাশায়েখরাও তাদের এসব থেকে মানা করে না। অথচ আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করলে তাদের সবদিক থেকে রিযিক দেওয়া হত।
রাসূলের (সাঃ) প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা প্রচার করতে বলা হয়। ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ মনে করা, ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করা, মারইয়াম (আঃ)-কে অপবাদ দেওয়া ইত্যাদি কুফরি আকিদা খণ্ডন করা হয়। দ্বীনের ভেতর এসকল বাড়াবাড়িমূলক বিশ্বাস ও কাজকে তিরস্কার করা হয়।
বনী ইসরাইলের মধ্যকার কাফিরদেরকে দাউদ (আঃ) ও ঈসা (আঃ) এর মুখ দিয়ে অভিশাপ দেওয়ানো হয়েছে।
মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকার পরও ইয়াহুদীরা যে শত্রু মুশরিকদের সাথে গোপনে আঁতাত করে চলে, তা উন্মোচন করা হয়েছে। মুসলিমদের সাথ শত্রুতায় সবচেয়ে কঠোর হলো ইয়াহুদী ও মুশরিকরা। খ্রিষ্টানদের মাঝে জ্ঞানী, দুনিয়াবিমুখ ও নিরহংকারী লোক আছে। তাই অমুসলিম সম্প্রদায়সমূহের মাঝে তারাই মুসলিমদের প্রতি বন্ধুত্বে সবচেয়ে নিকটবর্তী।