১। সূরা ফাতিহা, আয়াত ১-৭

সূরা ফাতিহায় বান্দা আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাগুণ বর্ণনা করে। সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর প্রাপ্য। তিনি মানুষের জানা-অজানা সকল কিছুরই প্রতিপালক। তিনি সাধারণভাবে সকলের প্রতি দয়াবান (রহমান), তাঁর দেওয়া সূর্যের আলো, নদীর পানি সকলেই পায়। কিন্তু বিশেষভাবে শুধু মুমিনদের প্রতি দয়ালু (রহীম), জান্নাত শুধু মুমিনরাই পাবে। তিনি বিচার দিবসের মালিক। তারপর একমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করা ও তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়ার কথা স্বীকার করা হয়। এই শিষ্টাচারের পর আল্লাহর কাছে সরল পথ চাওয়া হয়। এই পথে আল্লাহর নিয়ামাতপ্রাপ্ত বান্দারা চলেছেন। এঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীক্বগণ, শহীদগণ ও সলিহগণ। এবং তাদের পথ থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া হয়, যাদের ওপর আল্লাহর গযব (ইয়াহুদী) এবং যারা পথভ্রষ্ট (খ্রিষ্টান)।

০২। সূরা বাকারা, আয়াত ১-২০১

কুরআনকে মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াহ বলার পর মুত্তাকীদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। তারপর কাফির ও মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর কাফির মুনাফিকদের অবস্থা কয়েকটি উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের ওপর আল্লাহর বিভিন্ন অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে তাঁর দাসত্ব করতে বলা হয়। কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করলে অনুরূপ সূরা তৈরি করার চ্যালেঞ্জ করা হয়। কাফিরদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি ও ঈমানদারদের জন্য জান্নাতের নিয়ামতের কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়। কুরআনে আল্লাহ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুর উপমা কেন ব্যবহার করেন, এ ব্যাপারে কাফিরদের আপত্তির জবাব দেওয়া হয়েছে। উল্টো তাদের ভণ্ডামিগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

আল্লাহ কর্তৃক আদম (আঃ) এর সৃষ্টির ইচ্ছা করা থেকে শুরু করে আদম-হাওয়া (আঃ) এর জমিনে অবতরণ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা পাওয়া পর্যন্ত ঘটনা বর্ণিত হয়। ওয়াহী আকারে আসা এসব হিদায়াতের অনুসরণ যারা করবে, তারা জান্নাতি। অন্যথায় জাহান্নামি।

বনী ইসরাইল, ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের উদ্দেশ্য করে ঈমান আনার জন্য দীর্ঘ নসিহত করা হয়। সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রণ ও সত্য গোপন করতে নিষেধ করা হয়। বনী ইসরাইলের ওপর আল্লাহর বিভিন্ন নিয়ামতের কথা স্মরণ করানো হয়। তাদেরকে মানবজাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান, ফিরাউন ও তার দলকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে তাদের মুক্ত করা, মূসার (আঃ) অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাছুরপূজা করার পরও তাদের ক্ষমা করা, আসমান থেকে মান্ ও সালওয়া পাঠানো, পাথর থেকে তাদের বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রদানের কথা স্মরণ করানো হয়। এরপরও তারা নানাভাবে মূসা (আঃ) কে কষ্ট দেওয়া ও অন্য অনেক নবীকে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে আযাবে পতিত হয়। আগের উম্মতদের মাঝে যারা তাওহীদের ওপর মৃত্যুবরণ করেছে, তারা আখিরাতে পুরষ্কার পাবে। এছাড়া বনী ইসরাইলের সীমালঙ্ঘনকারীদের বিভিন্ন আযাব দেওয়া হয়েছিল, তা স্মরণ করানো হয়। তাদের মাথার ওপর তূর পর্বতকে এনে তুলে ধরা, শনিবারের আইন অমান্যকারীদের বানরে পরিণত করা ইত্যাদি। তাদের মাঝে এক ব্যক্তির হত্যাকারীকে আল্লাহ অলৌকিকভাবে সনাক্ত করে দেন। তা হলো একটি গাভী জবাই করে তার গোশত মৃতের গায়ে মারা, এতে সে জীবিত হয়ে অপরাধীর নাম বলে দেয়। এই গাভী জবাইয়ে অনীহার কারণে বনী ইসরাইল বারবার মূসা (আঃ) এর কাছে এর বয়স, রং ইত্যাদি নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে কালক্ষেপণ করেছিল। এত এত নিদর্শন দেখানোর পরও তাদের অনেকের অন্তর পাথরের চেয়ে শক্ত রয়ে যায়।

বনী ইসরাইলের স্বভাব স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে। এরা আসমানী কিতাবে রাসূলের (সাঃ) আগমন সম্পর্কে পড়েছে, কিন্তু জিদের বশে সে কথা গোপন করছে এবং কিতাব বিকৃত করেছে। আখিরাতে জান্নাতে যাওয়ার ব্যাপারে তারা খুব আত্মবিশ্বাসী। আল্লাহ তাদের দ্বীন অমান্য করার ফিরিস্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জান্নাত পাওয়ার সঠিক ক্রাইটেরিয়া জানিয়ে দেন। তাদের বংশ থেকে শেষ নবী আসেনি বলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, অথচ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নবুওয়ত দেওয়ার অধিকার রাখেন। তাদের আরো ভণ্ডামি উন্মোচন করে বলা হয় তারা যদি আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী হয়েই থাকে তাহলে পূর্বের নবীদের হত্যা করলো কেন। এরা জান্নাতে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হলে মৃত্যু কামনা করে না কেন? বরং দুনিয়ার জীবনকে এরাই বেশি ভালোবাসে। 

সুলাইমান (আঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা জাদুবিদ্যা চর্চার অভিযোগ করত (জাদুবিদ্যা কুফরি)। আল্লাহ তাদের এ ধারণা খণ্ডন করে জাদুটোনার আসল ইতিহাস বলেন। ব্যাবিলনে হারুত-মারুত দুই ফেরেশতাকে দিয়ে আল্লাহ জাদুর শিক্ষা দুনিয়াতে পাঠান পরীক্ষাস্বরূপ। ফেরেশতাদ্বয় খোলাখুলি বলে দিতেন যে জাদু শেখা কুফর, তারপরও ক্ষমতার লোভে পড়ে মানুষ তা শিখত এবং নানা অনাচার ঘটাত।

ইহুদীরা দ্ব্যর্থবোধক কথা বলে রাসূলকে (সাঃ) গালি দিত। আল্লাহ ঈমানদারদের এসব দ্ব্যর্থবোধক কথা বাদ দিয়ে স্পষ্ট বাচনভঙ্গি শেখান।

কোনো আয়াত বা আয়াতের হুকুম রহিত করে নতুন হুকুম বা আয়াত কেন আনা হয়, তার হেকমত বর্ণনা করা হয়েছে।

ইহুদী-খ্রিষ্টানরা আল্লাহর সন্তান আছে বলে যে আকিদা পোষণ করে তা খণ্ডন করা হয়েছে। ঈমানদাররা এদের মিল্লাত অনুসরণ না করা পর্যন্ত তারা যে ঈমানদারদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, এ ব্যাপারে সাবধান করা হয়। বনী ইসরাইলের মাঝে যারা শেষ নবীর ওপর ঈমান এনেছে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে।

মুসলিম, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সকলের সম্মানিত ব্যক্তি ইবরাহীম (আঃ) এর কথা স্মরণ করানো হয়েছে। তাঁর বংশধরদেরকে আল্লাহ মানবজাতির নেতা বানানোর ওয়াদা করেন, কিন্তু জালিমরা এ ওয়াদার বাইরে। ইবরাহীম ও ইসমাইল (আঃ) এর কাবা নির্মাণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি তাঁর বংশধরদের এই দ্বীন পালন করার ওসিয়ত করে যান এবং তিনি ছিলেন দ্বীন ইসলামের অনুসারী। তাঁর বংশে অনেক নবী আসে, সকলেই এই দ্বীনের অনুসারী ছিলেন এবং নিজ বংশধরদের এই দ্বীন পালন করার ওসিয়ত করে গেছেন। ইবরাহীম (আঃ) ইহুদী-খ্রিষ্টানদের মতো শিরকি আকিদা লালন করতেন না। মুসলিম হতে হলে সকল নবীর ওপরই ঈমান আনতে হবে।

আল্লাহর আদেশে মুসলিমদের কিবলা বায়তুল আকসা থেকে পাল্টে মাসজিদুল হারামের দিকে নির্ধারিত হয়। কাফিররা এটা দেখে নিন্দা ছড়াতে থাকে যে মুসলিমরা একেকবার একেকদিকে ফিরে ইবাদাত করে। আল্লাহ এদের খণ্ডন করে বলেন যে পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করার নাম ইবাদাত না, আল্লাহ যেটা করতে বলেন সেটাই ইবাদাত। আল্লাহর আদেশে কিবলা পরিবর্তন হয়েছে, এখন এদিকে ফিরেই সালাত আদায় করতে হবে। কিন্তু এই বিধানের পূর্বে আকসার দিকে ফিরে যেসব সালাত পড়া হয়েছে, তার সাওয়াবও নষ্ট হবে না।

সালাত ও সবরের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার ফজিলত, শহীদদের মর্যাদা, দুনিয়াবি বিপদ আপদ পাঠানোর পেছনের হেকমত, এবং এসব পরিস্থিতিতে ইন্নালিল্লাহ...পড়ার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

মুশরিকরা হাজ্জ করার সময় সাফা-মারওয়ার মাঝে দৌড়াদৌড়ি (সাঈ) করত। সাহাবাগণ চিন্তিত ছিলেন যে এটা করা ঠিক হবে কিনা। আল্লাহ আয়াত নাযিল করে জানান এটা হাজ্জেরই অংশ এবং সাওয়াবের কাজ।

যারা আল্লাহর কিতাবের কথা গোপন করে, তাদের ওপর লানত। তবে যারা এ পাপ থেকে তাওবাহ করেছে, তাদের কথা আলাদা। দুনিয়াতে কাফিররা তাদের নেতাদের অনুসরণ করার কারণে আখিরাতে যে আযাব পাবে, তার ফলে এই অনুসরণের ব্যাপারে তারা আফসোস করবে। বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ ত্যাগ করে আল্লাহর আদেশ মানতে বলা হয়।

হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার করতে বলে হারাম খাদ্যের তালিকা বর্ণনা করা হয়। আসমান-যমীন সহ পুরো সৃষ্টিজগতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শনের কথা বর্ণনা করা হয়।

কিসাস (খুনের বদলা), সম্পদের উইল, ফরজ রোজা, রোজার কাফফারা, রমজানের ফজিলত, রমজানের রাতে সহবাস করা, চাঁদ দেখে মাস গণনা, জিহাদ, হাজ্জ-উমরাহ সংক্রান্ত বিবিধ বিধান বর্ণনা করা হয়।