৬১৭ হিজরি।
আগের বছর তাতারদের হাতে পতন ঘটেছে খাওয়ারেজম সাম্রাজ্যের। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তাতার ত্রাস। ইবনুল আসীর লিখেছেন, মুসলমানদের মাঝে তাতার ভীতি এত প্রকট ছিল যে, একজন তাতার একটি গলিতে প্রবেশ করে। সেখানে একশোজন মুসলমান ছিল। সেই তাতার একে একে তাদের প্রত্যেককে হত্যা করে। কিন্তু তারা কেউই তাকে প্রতিরোধ করার চিন্তাও করেনি।
৬১৭ হিজরিতে তাতাররা আজারবাইজানের একাংশ দখল করে ফেলে। এসময় শোনা যায় তারা উত্তর ইরাকের মসুলে আক্রমণ করবে। দূর্বল আব্বাসি খলিফা নাসির লিদিনিল্লাহ এবার তাতারদের ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেন। তিনি তাতারদের মোকাবেলা করার জন্য বাহিনী গঠন করেন।
তার সেই বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল মাত্র ৮০০ জন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি এর চেয়ে বেশি সেনা যোগাড় করতে পারেননি। এই ক্ষুদ্র বাহিনী দেখে তাতাররাও বিশ্বাস করতে পারেনি। তারা ভেবেছিল এই ছোট বাহিনীর পেছনে আব্বাসিদের মূল বাহিনী এগিয়ে আসবে। তাই তারা লড়াই না করেই ফিরে যায়। (১)
এ ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। কেনো খলিফা চেষ্টা করেও ৮০০ জনের বেশি সেনা যোগাড় করতে পারেননি? কেনো কেউ তাতারদের বিরুদ্ধে লড়তে রাজি ছিল না? বাগদাদের তরুণ ও যুবকরা কোথায় ছিল?
প্রথমত, তাতারদের ব্যাপারে সবার মনে তীব্র আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, সে সময় সবার ভাবনা ছিল নিজেকে ঘিরে, নিজের শহরকে ঘিরে। বাগদাদ নিরাপদ আছে, দজলায় কিশতিতে করে ভ্রমণ করা যাচ্ছে, তুর্কী দাসিদের সৌন্দর্য চক্ষু শীতল করছে, দানানির বারমাকিয়্যা ও মাহবুবার সুললিত কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে, অযথা উত্তর ইরাকের মসুলে কী হচ্ছে তা নিয়ে পেরেশান হওয়ার কী দরকার?
এক বছর ধরে মুসলিম ভূখন্ডে তাতাররা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তা নিয়ে বাগদাদের লোকজনের কোনো চিন্তা বা পেরেশানি ছিল না। বরং আমিরদের কেউ কেউ এর থেকে বেশি পেরেশান ছিল তাদের গায়ক গোলামদের নিয়ে। একজন তো বলেই বসেছিল, এই গোলামকে হারানো আমার জন্য বাগদাদ হারানোর চেয়েও বেশি কষ্টকর। এমনকি ইরাক হাতছাড়া হলেও আমার এতটা কষ্ট লাগবে না। (২)
খিলাফাহর রাজধানী ব্যস্ত ছিল মদ-নারী ও গানবাজনা নিয়ে। হালাকু খান যখন মোসুলের আমির বদরুদ্দিনের কাছে মিনজানিক চেয়ে দূত পাঠিয়েছিল, একই সময় খলিফা মুস্তাসিম দূত পাঠিয়ে কয়েকজন গায়িকা দাসী চেয়েছিলেন। এমনকি তাতাররা যখন বাগদাদের কাছে চলে এসেছে খলিফা মুস্তাসিম তখনো আরাফা নামক দাসীর নাচ দেখতে ব্যস্ত। (৩)
মুসলিম ভূখন্ডে তাতারদের আক্রমণ শুরু হয় ৬১৬ হিজরিতে। আর তাদের হাতে বাগদাদের পতন হয় ৬৫৬ হিজরিতে। মাঝের ৪০ বছরে একের এক শহরে নির্বিচারে তারা আক্রমণ চালিয়েছে তারা। কিন্তু খিলাফাহর পক্ষ থেকে তাতারদের প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। বিভিন্ন শহরের মুসলমানদের অবস্থাও ছিল স্বাভাবিক। নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলমানদের নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তাদের।
--
কয়েক শতাব্দী পর ইতিহাসের এসব বিবরণ আমাদেরকে সে সময়কার মানুষজনের প্রতি বিরক্ত করে তোলে। তাদের বোকামি ও গাফলতির বিবরণ পড়ে আমরা তাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হই। কিন্তু যদি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে আমাদের অবস্থাও সেকালের লোকজনের চেয়ে ভালো কিছু নয়। একের পর এক ফিতনা ধেয়ে আসছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শত্রুর আবির্ভাব ঘটছে, আমরা এখনো অনর্থক বিনোদন, পারস্পরিক বিভেদ এসবে ব্যস্ত। সময়গুলো কাটছে অবহেলায়, অলসতায়।
আশপাশের সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত নই, এটা বলা ভুল হবে। আমরা বেশ ভালোভাবেই অবগত চারপাশে কী হচ্ছে। কিন্তু এখনো আমরা অসচেতন। সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের আলাপ আলোচনা শুধু মজলিসের জৌলুস বৃদ্ধি করে কিংবা অন্যকে আক্রমণ করার কাজেই ব্যবহৃত হয়। এখনো আমাদের কাছে সমস্যাগুলো দূরের সমস্যা, কাছের নয়।
দুরের কথা বাদই থাক। নিজ জনপদের মানুষদের ঈমান-আকিদা নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। কখনো কাদিয়ানি, কখনো হিজবুত তাওহিদ, কখনো মিশনারীরা হামলা করে অল্পমূল্যে তাদের ঈমান-আকিদা কিনে নিচ্ছে। মানুষ জানতেও পারছে না কত অল্প দামে সে কত মূল্যবান জিনিস বিকিয়ে দিচ্ছে। আধিপত্যবাদীরা কড়া নাড়ছে দুয়ারে, একের পর এক সংকেত দিচ্ছে তারা। আমরা এখনো ব্যস্ত আমোদ-প্রমোদে। যেভাবে তাতার হামলার সময় কবুতরের খেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন খলিফা নাসির লিদিনিল্লাহ। এডেসায় রোমানদের আক্রমণের সময় শিকার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বুওয়াইহি শাসক বখতিয়ার।
মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সামাজিক নৈতিকতার কাঠামোগুলো ভেঙ্গে গেছে, পারিবারিক বন্ধন প্রতিনিয়ত হালকা হচ্ছে, সবকিছু এক অশনী সংকেত নির্দেশ করছে।
এখনই সময় সচেতন হওয়ার। নিজেকে তৈরী করার। নিজেকে ঈমান-আমল-তাকওয়ার গুনে সজ্জিত করার।
তাতার হামলার প্রাক্কালে বিখ্যাত সুফী বুজুর্গ নাজমুদ্দিন রাজি তার লিখিত মিরসাদুল ইবাদ গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছিলেন, অভিশপ্ত তাতাররা আমাদেরকে যে ফিতনা-ফাসাদে ডুবিয়ে দিয়েছে তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। এখনো যদি আমাদের নেতৃত্ব সচেতন না হন, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে না তোলেন, তাহলে অচিরেই মুসলিম ভূখন্ডে তাতারদের বিজয় নিশান উড়বে।
নাজমুদ্দিন রাজি এ আহবান জানিয়েছিলেন শাসকদের প্রতি। বর্তমানে তার এ আহবান সবার জন্য প্রযোজ্য। এই ক্রান্তিকালে আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে। অলসতা ও অবহেলার ঘূর্নিপাক থেকে বের হয়ে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। তবেই কেবল রক্ষা পাব আমরা। নইলে আমাদের জন্যেও অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি।
ইতিহাসের সাধারণ নিয়ম, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়।
সূত্র
----------
১। আল কামিল ফিত তারিখ, ১০/৪১৩- ইবনুল আসীর।
২। আত তাতার বাইনাল ইনতিশার ওয়াল ইনকিসার, পৃ- ৪২ – আলি মুহাম্মাদ আস সাল্লাবি।
৩। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৭/৩৫৬- ইবনু কাসির।
Tuesday, 20 August 2019 at 19:29