দামেস্কে তীব্র যুদ্ধ চলছে রোমান বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর। রোমান সেনাপতির ছোড়া বিষাক্ত তীর এসে বিঁধল সাহাবী আবান ইবনে সাইদ ইবন আল আসের (রাঃ) গায়ে। তিনি শহীদ হলেন। আবান ইবনে সাইদ সদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন চাচাত বোন উম্মে আবান বিনতে উতবাহ ইবনে রাবিয়াহর সাথে। উম্মে আবানের হাতের মেহেদী তখনো শুকোয়নি, বিয়ের দিনের সুগিন্ধী এখনো গায়ে লেগে আছে। প্রিয়তম স্বামীর শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে তিনি ভগ্ন হৃদয়ে এসে দাঁড়ালেন লাশের পাশে। আল্লাহ্‌ আযযা ওয়া যালের কাছে ইউমাল কিয়ামাহর দিনের অফুরস্ত পুরষ্কারের আশা বুকে বেঁধে উম্মে আবান পুরোটা সময় ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং আবেগতাড়িত কন্ঠে বলেছেন

"আল্লাহ্‌ তোমাকে যা দান করেছেন সেটা পাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়। নিশ্চয় এখন তুমি মহান রবের রহমতের সুধা পান করছো, জান্নাতে আয়ত লোচনা হুরেরা তোমাকে আপ্যায়ন করছে। তুমি আমাদের রবের সান্নিধ্যে চলে গেছো যিনি এই দুনিয়াতে আমাদেরকে একত্রিত করেছেন, আবার আলাদাও করেছেন। সেই মহান রবের শপথ! আমার হৃদয়ে তোমার ভালোবাসা চির অমলিন আছে, থাকবে। আমিও আল্লাহর পথে এভাবেই মরণপণ লড়াই করে যাবো, যাতে আল্লাহ্‌ আযযা ওয়া যাল আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন এবং জান্নাতে আমাদেরকে আবারো একত্রিত করে দেন। বিয়ের পর আমি তো তোমাকে ভালোমত দেখতেই পারিনি। না আমি তোমার সাথে কিছু সময় কাটাতে পেরেছি, না তুমি। এটা আল্লাহর ফয়সালা ছিলো যে, এই দুনিয়াতে আমাদের ইচ্ছেগুলো অপূর্ণই থাকবে। তোমার পরে অন্য কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করবে, এটা আমি নিজের জন্য হারাম করে নিলাম। আজ থেকে আমি আল্লাহর পথেই নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলাম। আমাদের রব একদিন নিশ্চয় আমাদেরকে আবার মিলিয়ে দিবেন।"

বলা হয়ে থাকে উম্মে আবানের মত এত কঠিন ধৈর্যশীল আর কেউ ছিলো না। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) আবান ইবনে সাইদের জানাজা পড়ালেন। এরপর তার দাফন কাফনও সম্পন্ন হয়। উম্মে আবান এক মুহুর্তও দেরী করলেন না। নিজেকে রণসাজে সজ্জিত করে খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে না জানিয়েই মুসলিম বাহিনীর ভিড়ে মিশে গেলেন। তিনি সৈন্যদলকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার স্বামী কোন গেটে শহীদ হয়েছেন?' তারা জবাব দিলো, 'থমাস গেটে। আসলে থমাসই তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে।'

উম্মে আবান সাহাবী শুরাহবীল (রাঃ) এর সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিলেন। মুসলিম বাহিনী রোমানদের উপর ভয়াবহ এক হামলা চালালো। রোমান সেনাপতি থমাস অবাক বিস্ময়ে দেখলো শুরাহবিল (রাঃ) রোমানদের পতাকা বহনকারীর হাতে থাকা গ্রেট ক্রস দখলে নিয়ে নিয়েছে। থমাস এটা দেখে পাগলপ্রায় হয়ে শুরাহবিলের পেছনে ছুটতে থাকলো আর বলতে থাকলো 'ক্রস ফিরিয়ে দে, নয়তো আজ তোর কপালে খারাবি আছে!

এটা দেখে উম্মে আবান জিজ্ঞেস করলো, কে ওটা?

কেউ একজন জবাবে বলল, "তোমার স্বামীর হত্যাকারী, থমাস।"

এটা শুনে উম্মে আবান আর দেরী করলেন না। তুমুল বেগে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একসময় তিনি থমাসের কাকাকাছি পৌঁছে গেলেন এবং 'মহান আল্লাহর নামে এবং রাসূল (সঃ) এর বরকতে' উচ্চারণ করতে করতে থমাসের দিকে তীর ছুড়ে মারলেন। থমাস প্রায় শুরাহবিল (রাঃ) কে ধরে ফেলছিলেন, কিন্তু তার আগেই উম্মে আবানের তীর তার চোখে গিয়ে আঘাত করে এবং সেখানেই সে থেমে যায়। থমাস চিৎকার করতে করতে পালাতে থাকে, উম্মে আবান আবারো তীর ছুড়তে থাকেন। রোমানরা উম্মে আবানকে পাকড়াও করার চেষ্টা করেছিলো যদিও, কিন্তু তার আগেই মুসলিম বাহিনী তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনে। নিরাপদ দুরুত্বে এসেও উম্মে আবান রোমানদের উদ্দেশ্যে তীর ছুড়তে থাকে, এতে এক রোমান সেনার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়।

প্রিয় মানুষের প্রতি উম্মে আবানের এই ভালোবাসা আজকের দিনে তো অসম্ভব প্রায়। সেলুলয়েডের রঙিন পর্দায় ভালোবাসার যে গল্পগাথা আমাদের দেখানো হয়, সে মুখস্থ বুলি কখনোই উম্মে আবানের হৃদয়ের কাব্যগাথার সাথে তুলনীয় নয়। আল্লাহর রাসূলের চারদিকে এমন সব মানুষেরাই ছিলো, যাদের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা খোদ অমুসলিমদেরকেও ছুঁয়ে যেত। অথচ আজ আমরা ভালোবাসার স্বরূপ খুজি নাটক-সিনেমার মিথ্যে নাটুকেপনা আবেগে। ভালোবাসা তো সেটাই যা উম্মে আবান দেখিয়েছেন। তিনি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জতের নির্ধারিত ক্বদরে ধৈর্য ধরেছেন। তিনি প্রিয়তম স্বামীর সাথে জান্নাতে একত্রিত হওয়ার বাসনায় আল্লাহর পথে কদম বাড়িয়েছেন। আমরাও যেন এভাবে ভালোবাসা খুঁজে আনি, প্রিয় মানুষের সাথে একত্রে জান্নাতে মিলিত হওয়ার বাসনায়।


Tuesday, 21 November 2017 at 06:20