ভোর ৪:৩৮ এ বাস নামিয়ে দিলো চান্দিনা। এত তাড়াতাড়ি চলে আসবো ভাবতেও পারিনি। ফজরের জামাত ৬:১০ এ। এখনো প্রায় দেড় ঘন্টা বাকি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রামমোহন রোডের মাথায় গিয়ে দেখলাম একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়া চাইলো দেড়শো। ১২০ পর্যন্ত বলে একটা চায়ের দোকানে এসে বসলাম। পরোটা ভাজছে সাথে চলছে স্পিকারে কাওয়ালি গান। ভাবলাম এই ভাড়ায় না গেলে ফজর পর্যন্ত চুপচাপ এখানেই বসে থাকবো। ড্রাইভারও এসে দাঁড়ালো। অনেক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর আরেকজন সিএনজির ড্রাইভার এসে বসলো। কই যাবেন? ইত্যারপুর। কত দিবেন? ১২০ বলছি উনাকে। উনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যাবেন? না গেলে আমিই যাই? ড্রাইভার কিছুক্ষণ গাইগুই করে রাজি হলেন। রাস্তা পুরো ফাঁকা, ১০ মিনিটের মাথায় বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলেন।

এতক্ষণে ৫ টা বাজে। বাড়িতে জোফা কাকা থাকেন। উনি কানে একটু কম শোনেন, এই রাতে উনাকে ডেকে তুলতে গেলে পুরো বাড়ির মানুষ উঠে যাবেন। লাইলিকে একটা ডাক দিলাম। আশা ছিলো সিএনজির আওয়াজে হয়তো ঘুম ভেঙ্গেছে এক ডাকেই উঠে যাবে। জবাব পেলাম না। ফোন দিলাম দুইটা নাম্বারে। একটা ব্যস্ত বললো। এটা ওর ফোনের সমস্যা। কল দিলেই ব্যস্ত দেখায়। আরেকটা নাম্বার ফোন ধরলো। হ্যালো? ঘুম জড়ানো গলা, আমি এক নিঃশ্বাসে বলে গেলাম, লাইলি ঘুম থেকে উঠছিস? ভাইয়ে তো বাড়িতে আসছিলাম। ঢুকতে পারছিনা। ওপাশ থেকে বললো, এটা রং নাম্বার। এদিকে ফোনে চার্জ ১০ পার্সেন্টের নিচে নেমে এসেছে, মাত্রই ওয়ার্নিং দিলো। উপায়ন্তর না দেখে মসজিদের দিকে হাঁটা দিলাম।

বাড়িতে এসে এই প্রথম ঘরে ঢুকতে পারছিনা ব্যাপারটা এমন না। একদিন ভরদুপুরে আমি যোহর পড়ে বাড়িতে এসে দেখি মা দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। মাকে জেগে তুলতে মন চাচ্ছিলোনা। মায়েদের ঘুম বরাবরই অমূল্য। কেউই মনে হয় ঘুমন্ত মাকে ডেকে তুলেনা। আমি ঘরের বাইরে সিড়িতে বসে অপেক্ষা করছি। বসে আছি আর ভাবছি, নিজের ঘর, ঘরে মা ঘুমাচ্ছেন তাও আমি ভেতরে ঢুকতে পারছিনা। দুনিয়াটা কি অদ্ভুত! আমরা যা কিছু নিজের বলে দাবি করি, সবকিছুই আল্লাহ একটা সীমিত সময়ের জন্য আমাদের ব্যবহার করতে দেন। আল্লাহ চাইলে সবকিছু রেখেই আমাকে ওসবের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। খুব অসহায় লাগছিলো তখন। এক সময় মার নড়াচড়া টের পেয়ে ডাক দিলাম, মা দরজা খুলে বললেন, কিরে তুই কতক্ষণ এখানে বসে আছিস? ডাকবিনা আমাকে?

ভাবছিলাম মসজিদের বারান্দায় বসে অন্তত ফজর পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। ঘন্টাখানেকের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু মসজিদের বারান্দায় তালা ঝুলানো। বারান্দায় কখনো তালা থাকেনা। লাইট মেরে দেখলাম মুয়াজ্জিনের রুমেও তালা ঝুলছে। ব্যাগগুলো ওযুখানায় রেখে ফোনটা পাওয়ার ব্যাংকে লাগিয়ে মসজিদের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সামনে বিশাল পুকুর, পাশেই রাস্তা দিয়ে দুয়েকটা অটো সিএনজি যাচ্ছে গ্যাস আনার জন্য। গাছের পাতা বেয়ে শিশির গড়িয়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নাই। হঠাৎ খানকাহর মসজিদের মাইক থেকে কাদির হুজুরের কন্ঠ ভেসে উঠলো। ভাবলাম তাহাজ্জুদের জন্য হয়তো ডেকে দিবেন। এই কাজটা উনি প্রায়ই করতেন আগে। কিন্তু করুণ সুরে ভেসে এলো একটি মৃত্যু সংবাদ।

আসকর আলীর ব্যাটা মোসলেম মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রজিউন। কাদির হুজুর বেশ কয়েকবার রিপিট করলেন খবরটা। এরপর এলাকাবাসীকে ঘুম ছেড়ে উঠতে বললেন। তাহাজ্জুদ পড়তে বললেন। একদিন সবাই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে এই কথাটা মনে করিয়ে দিলেন। চিটাগঙ্গের পীর সাহেবের ২৫ জন খলিফা ছিলো এই এলাকায়, ধীরে ধীরে সবাই মারা গেছেন কেবল কাদির হুজুরই বেঁচে আছেন এই তথ্যটা আমি আগে জানতাম না। এটাও উনি মাইকে বললেন। চুপচাপ শুনলাম সবকিছু। এখনো ফজরের ওয়াক্ত হয়নি। এক সময় কাদির হুজুরের এলান শেষ হয়ে গেলো। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো আমার চারপাশে।

এমন ভোর সকালে এর আগেও একবার বাড়িতে এসেছিলাম। তখন কলেজে পড়ি। একটা প্রজেক্টের কাজে খাগড়াছড়িতে গিয়েছিলাম। কাজ শেষে ঢাকায় ফিরছি। চান্দিনা যত কাছাকাছি আসছিলো ততই বাড়ির জন্য মন টানছিলো। বাড়িতে মা আর ছোটবোন তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আছে। বাড়িতে গেলে খুব ভালো একটা সময় কাটবে। কিন্তু এই শেষরাতে বাস থেকে নামবো কি নামবোনা, বাড়িতে যাব কি যাবনা এসব ভাবতে ভাবতেই চান্দিনা পাড় হয়ে মাধাইয়া চলে গেলাম। কিছুতেই মন মানছেনা। অগত্যা বাস থেকে নেমেই গেলাম। নেমে একটা সিএনজি পেলাম নিমসার যাচ্ছে শব্জি আনতে। ওটা দিয়ে চান্দিনা এলাম। তারপর এখানে ফজর পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফজর পরে বাড়িতে আসলাম। এত ভোরে বাড়িতে দেখে মা খুব অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, কিরে নাইটের গাড়িতে উটছিলি? আমি অস্ফুট জবাব দিয়ে ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম।

মসজিদের সামনেই বড় পুকুরের পাড়ে আমার দাদার ঘর। দাদার ঘরও খালি। ছয় ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে এক সময় এই বাড়িটা গমগম করতো। আব্বা সবার বড় ছিলেন। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। আব্বা-মা মিলিয়ে সাতজন মানুষ একটা ছোট মাটির ঘরে থাকতাম। সেখানে একসময় এতজন মানুষের জায়গা হতোনা। মা প্রায়ই বলতেন ঐ ঘরে ছিলো একটা চুলা। আমি ভয় পেতাম ঘুমের ঘোরে তুই চুলার মধ্যে চলে যাস কিনা। সেই বাড়ি ছেড়ে এসে জঙ্গল কেটে আলগা বাড়ি করলেন আব্বা। সেই বাড়িটাও গমগম করতে শুরু করলো একসময়। দাদার বাড়ি যেভাবে ছেড়ে আসলাম আমরা তেমনি আমাদের বাড়ি ছেড়েও মানুষজন চলে যেতে শুরু করলো। আব্বা গেলেন সবার আগে। তারপর দুই বোনের বিয়ে হলো। আমি স্কুলের হোস্টেলে। বড় ভাই দেশের বাইরে। সেই যে ঘর ছাড়তে শুরু করলাম আমরা ফেরত আর আসতে পারলাম না। কিছুদিন আগে মার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাড়িটার শেকড় কাটা গেলো। এই বাড়িতে এখন আর আমাদের কেউ থাকেনা। যেমন থাকেনা আমার দাদার বাড়িতে। দুই দুইটা বাড়ি কয়েক যুগের ব্যবধানে মানুষশূন্য হয়ে গেলো।

বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তার সাথে যোগ হয়েছে হালকা বাতাস। জান্নাতের বাতাস। আমি যখন ছোট ছিলাম ফজরের আজানেরও আগে ঠিক এই সময়টাতে আব্বা আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলতেন, চল। আমরা বের হতাম। স্কুলের মাঠে যেতাম। শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতাম। স্কুলে কিছু অর্জুন গাছ ছিলো। আব্বা বলতেন গাছটাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধর। ছোট্ট হাত আমার। গাছ বেড় পেতাম না, তাও ধরতাম। আব্বা বলতেন চুপচাপ গাছের ঘ্রাণ নে। অর্জুন গাছের ঘ্রাণ অনেক রোগ বালাই থেকে আসান দেয়। আমি চুপচাপ অর্জুন গাছ জড়িয়ে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নিতাম। পাশেই আরেকটা গাছে আব্বা জড়িয়ে ধরতেন। আব্বার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতাম। এই সময়টাতে একটা বাতাস বইতো দক্ষিণ দিক থেকে। শীতল লিরলিরে বাতাস। বুক ভরে শ্বাস নিতাম সেই বাতাসে। আব্বা বলতেন, এই বাতাসটা জান্নাতের বাতাস। আমি বিশ্বাস করতাম এটা জান্নাতেরই বাতাস। দিনের অন্য কোন সময় এই বাতাসটা পেতাম না আর। তারও অনেক সময় পর এক সময় মসজিদে আজান পরতো। আমি আর আব্বা মসজিদের দিকে হাঁটা দিতাম। আজকে অনেক দিন পর সেই জান্নাতের বাতাসটা গায়ে লাগলো আমার। কয়েক মূহুর্তের জন্য কেবল।

মসজিদের পাশেই আব্বা আর মা শুয়ে আছেন। পাশাপাশি দুইটা কবর। জান্নাতের বাতাসটা ওদিক থেকেই এলো বোধহয়। আমি একলা দাঁড়িয়ে আছি পাশেই। বিশাল এই পৃথিবীটাতে কোথাও যেতে না পারার এইযে একটা মূহুর্ত, এইযে একাকীত্ব, ছোট্ট বুকটা জুড়ে ব্ল্যাকহোলের মতো বিশাল একটা শূন্যতা, হাহাকার কে দেখলো? দুনিয়ার কেউই দেখলো না। একজন বাদে, তিনি কে? আমার আল্লাহ।

দুনিয়ার মানুষের কোন কথাই আমাকে এই পরিমাণ সান্ত্বনা দিতে পারেনি যেই সান্ত্বনাটা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আমার জন্যই বোধহয় আল্লাহ কুর'আনে সুরা তুরে একটা কথা বলেছেন,

❝যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান সন্ততিরা ঈমানের সাথে পিতামাতাকে অনুসরণ করে, আমি তাদের সাথে তাদের সন্তান সন্ততিকে মিলিত করব। তাদের ‘আমালের কোন কিছু থেকেই আমি তাদেরকে বঞ্চিত করব না। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ❞

আমার আব্বা এবং মা দুজনই ঈমানদার ছিলেন। আমরাও যদি ঈমানের সাথে তাদেরকে অনুসরণ করতে পারি তাহলে আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন আমাদেরকে আবার জান্নাতে মিলিত করবেন। এরচেয়ে বড় সান্ত্বনা দুনিয়ার কেউ দিতে পারে? কক্ষনো না।

দুনিয়াটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। চোখের সামনে দেখতে দেখতে দাদা চলে গেলেন, আব্বা গেলেন, মা গেলেন। এভাবে আমিও একদিন চলে যাবো। সর্বসুখের স্থান যে এই দুনিয়াটা না, এটা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছি। আমি মনে প্রাণে চাই দুনিয়াতে আমার দাদার যেমন একটা সুখের সংসার ছিলো, যেমনটা ছিলো আমার আব্বার, আল্লাহ যেনো এই সংসারের সবাইকে আবার জান্নাতে একত্রিত করেন ইন শা আল্লাহ।

হে আল্লাহ, আমাদের পিতামাতার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েন। কবরের আযাব মাফ করে দিয়েন। আমাদেরকে ঈমানের উপর অটল রেখে জান্নাতে আবার আমাদের সবাইকে এক করে দিয়েন। হে আল্লাহ, আপনার ওয়াদার উপরই ভরসা করলাম। নিশ্চয়ই আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। আমিন।

ইতোমধ্যে চারপাশে আজান পরতে শুরু করেছে। আকাশ ফরসা হচ্ছে ধীরে ধীরে। মুয়াযযিন আজান দিয়েছেন। এলাকার মুরব্বিরা আসতে শুরু করেছেন। মসজিদের দরজা খোলা হয়েছে। আমি ব্যাগগুলো রেখে অযু করে মসজিদে ঢুকলাম..