গত দুদিন যাবৎ বৃষ্টি হচ্ছে-- একঘেয়ে, একটানা। রাস্তা-ঘাটে পানি-টানি উঠে বিশ্রী অবস্থা, থলথলে কাঁদা, জুবজুবে ভেজা শার্টে ছেয়ে গেছে গোটা শহরটা। পত্রিকার ভাষায়-- "টানা বর্ষনে নাকাল শহরবাসী।" কথা ঠিক! আমি নাকাল হয়ে পড়ছি। আমি নাকাল পড়ছি এক অদ্ভুত ভালো লাগার ঘোরময় বিষন্নতায়, ঘরের জানালার কাছে থাকা গাছটার একটানা সরসর শব্দটায়, হীম করা বাতাস আর মাটির সোঁদা গন্ধটার মাদকতায়।
কিছু কিছু গন্ধ আমাকে পুরোনো স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় বারবার। আমি আজ পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম মাটির সোঁদা তীব্র ঘ্রাণটা আমার নাক দিয়ে ঢুকে বুকের সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে…যাচ্ছে…যাচ্ছে; শেষমেশ গিয়ে অনেকটা বুকে জমাট বেঁধে থাকা কফের মতো করে বাঁ পাশটাতে জমাট বেঁধে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কি অদ্ভুত! আমার মনে পড়ে যেতে থাকলো আমার শৈশবে কাটানো লালমাটিয়ার দিনগুলোর কথা। বৃষ্টির দিনগুলোয় স্ট্যাম্প, ব্যাট সবকিছু গ্যারেজে গুছিয়ে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলতে নেমে যেতাম রাস্তায়। কি উত্তেজনা! কি প্রবল উৎসাহ! দুর্দান্ত, ঘোরলাগা সময়গুলো। আহ!
আমি বরাবরই একটু ভাবালু টাইপের। খেলার ফাঁকের বিরতিতে কিংবা মাঝেমধ্যে অযথাই লাল রঙা ইঞ্জিনিয়ার বাড়ির চালতা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পানির ঝাপটাগুলো উপভোগ করতাম প্রচন্ডভাবে।
অঝরধারার বৃষ্টিগুলো আমার চুল হয়ে গড়িয়ে চোখের পাতার ওপর এসে স্থির হতো, চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যেতো বারেবার… সে ঝাপসা চোখের পানিগুলো হাতের তালু দিয়ে সরিয়ে দিতে যে কি এক অদ্ভূত ভালো লাগা কাজ করতো…কি অসহ্যকর এক ভালো লাগা!
মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে করে সেই অনুভূতিগুলোকে ফিরে পেতে। যদি পারতাম আমার সর্বস্ব দিয়ে সে সময়গুলোকে আমি আঁকড়ে ধরতাম। এতো তীব্র করে কীভাবে আমি অনুভব করতে পারতাম সবকিছু? কীভাবে পারতাম এতো সুন্দর করে সব শুভ্র-শুদ্ধতায় সবকিছুকে সাজাতে? আমি এখনও খুব করে ভালোবাসি আমার এই প্রাচীন অনুভূতিগুলোকে। এই স্মৃতিগুলোর মাঝেই আমার বর্তমান বসবাস। ভালো থাকা-মন্দ থাকার বড় একটা অংশ।
আজো ইচ্ছে করে ঠিক তেমন করে ভিজি। মনটার সাথে সাথে আমার চোখের পাতায় ঝাপসা বৃষ্টির ফোঁটা জমাই। হয় না! আজকাল আধঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজা মাত্রই মাথা-টাথা ধরে বিশ্রী এক অবস্থা হয়ে যায়।
নিজের অসহায়ত্বে ইদানিং মাঝে মাঝে অজান্তেই চোখে পানি জমে যায়। এখন ঠিক বৃষ্টি না, মাঝে মাঝে চোখের জলে ঝাপসা করি চোখ দুটো। এক বৃষ্টির মতো অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমার কত অস্বাভাবিক ছন্দ-কল্পনা–অনুভতি আর তার ব্যবচ্ছেদ। আহারে!
সবকিছু নিমিষেই কেমন যেন ইথারে হারিয়ে গেছে। আজ সকালে অফিসের করিডোরে নির্জনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে রাস্তায় অবিরত বর্ষাধারার বয়ে যাওয়া দেখছিলাম– প্রবল অসহায়ত্বে আমি অস্থির হচ্ছিলাম, বারবার…
বালক বয়সটাকে পুরোনো করে তাতে শ্যাওলা জমিয়ে বসে আছি বহু-বরষা আগেই,।সেটা ইদানিং আর ভাবতে ইচ্ছে হয় না। তবুও ভাবতে ভালো লাগে-- চালতা গাছের নিচে দাঁড়ানো সেই বালক আমাকে, চুল ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে নেমে পড়া পানির ফোঁটার আমিটাকে; আপনাকে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, বারেবারে…