[১]

জোন অফ আর্ক, ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজি, উসামা বিন জায়েদ- এরা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে জন্মেছে এবং বেড়ে উঠেছে। কিন্ত এদের মাঝে রয়েছে এক বিরল সাদৃশ্য। এরা প্রত্যেকেই জাতির সংকটময় মূহূর্তে নিজ নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে অকল্পনীয় পরিস্থিতির ভেতর বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এদের আরেকটা মিল হল ওরা সবাই ছিল টিনেজার- early teenager. অথচ তাদের বোঝার ক্ষমতা, মেধা, যোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা ছিল অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ এবং পরিপক্ক লোকজনকে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট। আজ পৃথিবীর কোথাও কি আমরা এমন একজন টিনেজার খুঁজে বের করতে পারব?

আমাদের টিনেজারদের দোষ নয়- তাদের বাবারা কলের ইঁদুরের মত টাকার পেছনে ছুটছেন, পরিবারকে এনে দিচ্ছেন সকলপ্রকার ধনসম্পদ প্রাচুর্য সম্ভার কিন্তু সন্তানের গঠনপ্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ করার সময় নেই; মায়েরা স্বাভাবিকভাবেই অনুভূতিপ্রবণ এবং সন্তানের কল্যাণকামী, কিন্তু স্বামীর অনুপস্থিতিতে সন্তানকে আগলে রাখার প্রবণতা বেড়ে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যা তাকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর স্বামী যখন সর্বদাই অনুপস্থিত তখন মায়ের এই অতিরিক্ত protectiveness সন্তানকে কি জোন অফ আর্ক বা বখতিয়ার খিলজি বানাবে না ভিডিও গেমে পুরো পৃথিবীকে কুপোকাত করে ফেললেও বাস্তব পরিস্থিতিতে অকেজো করে ফেলবে তা সহজেই অনুমেয়।

[২]

মিশরের প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহ ফেরাউন, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মহান অধিপতি, ধনৈশ্বর্যের কোন ঘাটতি নেই তার রাজ্যে, চারিদিকে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল পিরামিড তার নিজের এবং পুর্বপুরুষদের ক্ষমতার দম্ভের স্তম্ভ হিসেবে, রাজপ্রাসাদে উপচে পড়ছে সুখের সমস্ত আয়োজন- কিন্তু সে সুখী নয়, কারণ সারা পৃথিবী স্ত্রীর পদতলে উজার করে দিলেও তার স্ত্রীর কাছে তার ক্ষমতা এবং অহংকারের কোন মূল্য নেই। স্ত্রী আসিয়া তাকে মুখের ওপরেই বলে- এই ক্ষমতার উৎস অত্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এই প্রাসাদ আর পিরামিড দরিদ্রের অধিকার কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলা, সে এর কোন অংশই চায়না, সে ফেরাউনকে দেবতা বলেও স্বীকার করেনা বরং সে আল্লাহর কাছে জান্নাতে একটি ঘর চায়। চূর্ণবিচূর্ণ অহংকারে, রাগে, ক্ষোভে ফেরাউন প্রিয়তমা স্ত্রীকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে চুবিয়ে মারে। আসিয়া একে ফেরাউনের সাথে বসবাসের চেয়ে শ্রেয় মনে করে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদী এবং জীবনের প্রতি নির্মোহ মহিলা আজকে ক’জন পাওয়া যাবে?

আজকের নারী অপরিচিত পুরুষের মুখে সামান্য একটু প্রশংসা শোনার জন্য নির্দ্বিধায় পোশাক খুলে ফেলছে, সামান্য ক’টা টাকার জন্য বিকিয়ে দিচ্ছে নিজের সর্বস্ব, বাবা মা মেয়েকে মডেল বা অভিনেত্রী পরিচয় দিতে পেরে গর্বে বুক ফুলে ফেটে পড়ছেন- তারা কি জানেন না এর জন্য তাদের সন্তানটিকে কি কি করতে হচ্ছে? আজ একটা মেয়ের স্বপ্ন হয় ছোট্ট একটা ঘর, ছোট্ট একটা গাড়ী, স্বামীর ভাল চাকরী, ছোট্ট সুখের সংসার- হায়! ক’জন স্বপ্ন দেখে জান্নাতে একটি বাড়ীর?

[৩]

বিখ্যাত সেনা কমান্ডার হ্যানিবলকে যখন খবর দেয়া হল সামনে আল্পস পর্বত, এর ওপর দিয়ে কিছুতেই হাতি পার করা যাবেনা, তিনি বললেন, ‘I will either find a way or make one.’ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলতেন, ‘Impossible is a word to be found only in the dictionary of fools.’ তারিক বিন জিয়াদ অনিচ্ছুক সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার পথ রোধ করার জন্য জাহাজ জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের বললেন, ‘We now have the enemy in front of us and the deep sea behind us. We cannot return to our homes, because we have burnt our boats. We shall now either defeat the enemy and win or die a coward’s death by drowning in the sea. Who will follow me?’

আজকের যুদ্ধটা একটু অন্যরকম।
সৎভাবে উপার্জন করার কথা বললে একজন পুরুষ বলেন, ‘তাহলে আমার সংসার চলবে কি করে?’
জীবিকা এবং পরিবারের মাঝে সময় বন্টন করে দেয়ার কথা বললে বলেন, ‘দিনটা মোটে ২৪ ঘন্টার, এর মধ্যে এত কিছু কি করে ম্যানেজ করা সম্ভব?’
অন্যায় avoid করার জন্য চাকরী পরিবর্তন করার কথা বললে আঁতকে ওঠেন, ‘এই দুর্মূল্যের বাজারে চাকরী ছাড়লে আবার চাকরী পাবার নিশ্চয়তা কি?'

তাদের একবারও কি মনে আসে, সন্তানকে অন্যায়ের ভিত্তির ওপর খাইয়ে পরিয়ে বড় করলে সে সৎ এবং সাহসী মানুষ হবে তার নিশ্চয়তা কি?

[৪]

একজন মুহাম্মাদ, যেদিন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সেদিন অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলেন, নিজের ওপরেই আস্থা হারিয়ে ফেললেন। তখন একজন খাদিজা তাকে আশ্বস্ত করলেন, একজন সৎ ব্যক্তিকে কোন অন্যায় স্পর্শ করতে পারেনা, এবং জগতশ্রেষ্ঠা চার নারীর একজন হয়ে গেলেন। একজন আবু বকর দৃঢ়চিত্ত রইলেন, যে কোনদিন মিথ্যা বলেনি সে চল্লিশ বছর বয়সে মিথ্যা বলা শুরু করতে পারেনা তা তার কথাবার্তা যতই অবিশ্বাস্য শোনাক না কেন। একজন কিশোর আলী নেতৃস্থানীয় লোকদের পাহাড়প্রমাণ তাচ্ছিল্যের সামনে বুক চিতিয়ে বলল, ‘আপনার পাশে আর কেউ না থাকলেও আমি আছি।’ একজন উমার সত্যের স্পর্শে এক মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল। এভাবে একজন একজন মানুষ এক একটি বিশেষ মুহূর্তে এগিয়ে এসে সারিবদ্ধ হয়ে একটি সম্পূর্ণ পৃথিবীতে পরিবর্তনের ঢেউ ছড়িয়ে দিল। এভাবেই এক একজন মানুষ শুধু নিজের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে ভাবার মাধ্যমেও পুরো পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রশ্ন হল আমরা ব্যক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা ভাবছি কিনা।

[৫]

পরিবারে সবার বড় ছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখসমরে অভ্যস্ত। তাই পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, নৈরাশ্যবাদের বিলাসিতার সুযোগ হয়নি কখনো, রঙ্গিন চশমাও আঁটা হয়নি চোখে। জীবনকে দেখি প্রখর বাস্তবতার স্পষ্ট আলোয়।

আজকের পৃথিবীতে সৎ নেতার অভাব, সাহসী লোকের অভাব- নেতারা জনগণকে বিনোদনের রঙ্গিন চশমা পরিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে যেন সে সুযোগে তারা ইচ্ছেমত করতে পারে, তারা কখনোই চাইবেনা সমাজের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক, কারণ তখন সবাই তাদের পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবে; সংসারের ঘানিটানা জনগণের মাঝে জেগে ওঠার সাহসের অভাব, স্বপ্ন দেখার সাহসের অভাব, যদি স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, তার চেয়ে কল্পনার রঙ্গিন জগতে বসবাস করা সহজতর!

কিন্তু আসল অভাবটা অন্য জায়গায়। একটি সমাজ অনেকগুলো পরিবারের সমষ্টি। এই পরিবারকে গড়ে তোলেন একজোড়া পিতামাতা। একজন পিতা তার সন্তানকে শেখাবেন কীভাবে মাছ ধরতে হয়, কীভাবে শিকার করতে হয়, কীভাবে নদীতে সাঁতার দিতে হয়, কীভাবে নৌকা বাইতে হয়, কীভাবে গাড়ী চালাতে হয়, কীভাবে চাষ করতে হয়, কীভাবে বাজার করতে হয়, কীভাবে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখতে হয়- এই দায়িত্বগুলো একজন মাকে দিয়ে হয়না। বাবা যদি সময় দিতে ব্যর্থ হন তখন সন্তানের পৌরুষসূচক গুণাবলীতে ঘাটতি রয়েই যায়। একজন মা সন্তানকে শেখাবেন আদবকায়দা, ভদ্রতা, কোমলতা, গৃহের প্রতি দায়িত্ব, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সদাচরণ এবং তিনিই সন্তানকে শেখাবেন একবার পড়ে গেলে কিভাবে আবার উঠে দাঁড়াতে। মা যদি সময় বা সাহস দিতে ব্যর্থ হন তখন এই সন্তান যতই আদরযত্নে বেড়ে উঠুক না কেন তার এই দিকগুলো বিকশিত হবার সুযোগ পায়না।

আজকের ছেলেমেয়েরা বড় হয় ফার্মের মুরগীর মত করে- ফার্মের মুরগীর মতই তাদের কেবল দেহটা বাড়ে, কিন্তু তাদের বোধবুদ্ধিতে প্রসার ঘটেনা। ফলে এরা বড় হয়ে চাকরীবাকরী করে খেয়েপরে চলতে পারে, এর বেশি আর কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়না। এদের দিয়ে সমাজ পরিবর্তন তো দূরে থাক, সমাজের উপকার হবারও কোন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়না। তাই আজকাল একটি কিশোর তার ফ্লাস্ক থেকে ভিক্ষুকের গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছে দেখলে আমরা আপ্লুত হই, কেউ রাস্তায় টাকা পেয়ে মালিককে ফিরিয়ে দিলে অবাক হই, কেউ শালীনভাবে চললে তার প্রশংসা করি- আমাদের মাথায় এটা আসেনা যে এগুলো তো স্বাভাবিক মানবিকতার সর্বনিম্ন পর্যায়! অথচ পৃথিবীব্যাপী মানুষ পশুবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে; সামান্য ক’টা টাকার জন্য আমাদের আশেপাশেই মানুষ খুনজখম স্মাগলিং রাহাজানি ছিনতাই করছে; মানুষ মানুষকে মেরে ফেলছে, মাতৃগর্ভে শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছেনা- আর আমরা কি করছি? আমরা পেপার পড়ে মুখে ‘চু চু’ শব্দ করছি, নতুবা টিভিতে এই বীভৎসতা দেখে চ্যানেল পরিবর্তন করে দিচ্ছি, চায়ের কাপে ঝড় তুলে নাচগানের অনুষ্ঠানে ডুবে যাচ্ছি। ব্যাস, আমাদের দায়িত্ব শেষ! তাই ভাবি, পৃথিবীতে হয়ত এখন আর সৎ এবং সাহসী মানুষজন জন্মায়না- তাদের ধারণ করার মত মা এখন আর নেই, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মত বাবা এখন আর নেই, তাদের গ্রহণ করার মত সমাজ এখন আর নেই, তাদের মূল্যায়ন করার মত নেতৃত্ব এখন আর নেই। এটা নৈরাশ্যের কথা নয়, এটাই বাস্তবতা।