সময়ের সাথে সাথে যেসব অঞ্চলের ওপর প্রাথমিকভাবে ইমাম মুহাম্মাদের অনুসারীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোর ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা আলে সাউদের প্রথম প্রজন্ম এবং মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব এর সন্তানদের সময়কার কথা। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে তাঁদের বলতে গেলে কিছুই ছিল না। তাঁরা প্রায় নিঃস্ব ছিলেন।
পরবর্তী ঘটনা জানার আগে চলুন দেখি, মুহাম্মাদ (ﷺ) যখন তাঁর সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম দের হাবাশায় পাঠিয়েছিলেন, তখন কী হয়েছিল। জাফর ইবনু আবি তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘এ ব্যক্তির বংশের কেউ কি বাদশাহ ছিল?’ কেন এটা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল? কারণ, যদি কারো বংশে কোন শাসক বা নেতা থেকে থাকে, তাহলে ধরে নেয়া হতো যে ঐ ব্যক্তি হারানো কর্তৃত্ব ও রাজত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করছে।
তাই আমরা দেখি ১৯ শতকের গোড়ার দিকে আব্দুল আযীয আল-সাউদ আসলো। এবং তার ক্ষেত্রে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটেছিল। সে তার দাদার আমলের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলো। আর এ জন্য সে মুজাহিদীনদেরকে নিয়ে আসল যারা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের অনুসারী। মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের মুখলিস এবং মুত্তাকী উত্তরসূরীদের আব্দুল আযীয নিজ অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করলো। সে ছিল বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে চরম বিশ্বাসঘাতক। আব্দুল আযীয এবং তার সন্তানেরা, যতোজনকে এর মধ্যে আমরা দেখেছি, সবাই গাদ্দার।
আব্দুল আযীয মঞ্চে আসার পর প্রথম কী করলো? শুনুন, কুফফারের সাথে আলে-সাউদের চুক্তির ব্যাপারটা নতুন কিছু না। এটা তাদের রক্তে আছে। আব্দুল আযীয, তার বড় ছেলে, এদের রক্তেই বিশ্বাসঘাতকতা। এ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করার জন্য সে তার ছেলে ফায়সালকে (বাদশাহ ফায়সাল) লন্ডন পাঠায়। একদিকে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করার জন্য আব্দুল আযীয নিজের ছেলেকে পাঠাচ্ছে অন্যদিকে সে মুখলিস মুজাহিদিনকে জিহাদের নামে বোকা বানাচ্ছে। এই মুজাহিদিন নিজেদের রক্ত ঢালছেন কিন্তু তারা জানেন না আব্দুল আযীয তাঁদের ধোঁকা দিয়ে এরইমধ্যে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করে বসেছে।
একসময় এই মুখলিস মুজাহিদিন বাস্তবতা অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন। যেসব ঘটনার মাধ্যমে এ বাস্তবতা তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল লন্ডনে ফায়সালকে পাঠানোর বিষয়টা। আরেকটি ঘটনা ছিল, জাযিরার কিছু বাতিল ফিরকার ব্যাপারে আব্দুল আযীযের অবস্থান। রাফিদি শিয়াসহ আরো কিছু ফিরকার ব্যাপারে মুজাহিদিন বললেন, আমরা তাঁদের প্রকৃত ইসলাম গ্রহনের দাওয়াহ দেব অথবা এ ভূখণ্ড থেকে তাদের বিতাড়িত করবো। কিন্তু আব্দুল আযীয তা করতে অস্বীকৃতি জানালো। মুজাহিদিনের রক্ত আর দেহের ওপর দিয়ে আব্দুল আযীয তার রাজ্য বিস্তার করতে লাগলো।
যে ভূখন্ডকে আজ আমরা সাউদিয়া নামে চিনি সেটার দূরতম সীমান্ত পর্যন্ত মুজাহিদিন যখন পৌছে গেলেন তখন আব্দুল আযীয বললো, ব্যস, এখন জিহাদ থামিয়ে দাও। মুজাহিদিন বললেন, না! আমরা এখন থামতে পারি না। আমরা যুদ্ধ করে যাবো যতক্ষণ না ইসলাম পুরো পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করবে।
আব্দুল আযীয কী বললো?
ব্রিটিশরা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, এখানেই তোমাদের থামতে হবে।
এই গাদ্দার মুজাহিদীনকে কুফফার ব্রিটিশের ভয় দেখালো।
তখন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের সত্যিকারের অনুসারী এ মুজাহিদিনরা কী করলেন?
আমি একটা বই পড়ছিলাম। বইটা লিখেছে এমন এক ব্যক্তি যে এই মুজাহিদিনকে ঘৃণা করে। কিন্তু তবুও সে লিখতে বাধ্য হয়েছে, এই মুজাহিদীনের একনিষ্ঠতা ছিল অতুলনীয়। তাঁরা দুটো পরিণতির একটি খুজছিল। হয় বিজয়, আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, অথবা শাহাদাহ।
তাঁদেরকে ব্রিটিশদের ভয় দেখানো হল। এই মুজাহিদিন ছিলেন সাধারণ বেদুইন। আধুনিক পৃথিবীর অনেক কিছু সম্পর্কেই তাঁরা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের পরদাদা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব তাঁদের মধ্যে বিশুদ্ধ আক্বিদার ভিত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। মুজাহিদিনকে ভয় দেখানোর জন্য বলা হল, ব্রিটিশদের বিমান আছে!
এই সাধারণ বেদুইনরা বিমান কী, সেটা জানতেন না। তাঁরা প্রশ্ন করলেন, বিমান কী?
এটা আকাশে উড়ে বেড়ায়, অনেক অনেক উঁচু দিয়ে।
মুজাহিদিন আবার প্রশ্ন করলেন, আল্লাহ কি এই বিমানগুলোর ওপরে নাকি নিচে?
তখন আব্দুল আযীযের বার্তাবাহকেরা বলতে বাধ্য হল, অবশ্যই আল্লাহ এগুলোর ওপরে।
তখন মুজাহিদিন জবাব দিলেন, তাহলে বিমান নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
তারা ছিলে এমন বেপরোয়া, তাওয়াক্কুল সম্পন্ন এবং খালিস ঈমানের অধিকারী। তাঁদের মধ্যে এমন অকুতোভয় বিজয়ী মানসিকতা কিভাবে গড়ে উঠেছিল? ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব এর দাওয়াহর মাধ্যমে। বিশুদ্ধ আক্বিদার মাধ্যমে।
যা হোক মুজাহিদিন শেষ পর্যন্ত আব্দুল আযীযের কথা শুনলেন না। তাঁরা যুদ্ধ থামাতে অস্বীকৃতি জানালেন। তখন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের প্রকৃত অনুসারীদের সাথে আব্দুল আযীযের এক তীব্র সংঘর্ষ হল। পরে আব্দুল আযীযের ছেলেরা এই মুজাহিদীনদের হত্যাও করেছিল, এখানে আমি সেই বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।
[এ খন্ডে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও গুরুত্ব বিবেচনায় শেষের পর্বটি দু ভাবে ভাগ করা দেয়া উত্তম মনে হল। ইন শা আল্লাহ আগামী পর্বে সমাপ্য।]