মাঝে মাঝেই তোমার মন খারাপ হবে। ছুটির দুপুরগুলো কাটতে চাইবেনা কিছুতেই। ঈদের দিনগুলোতে ভীষণ একা একা লাগবে। খুব স্বাভাবিক ভাই। সবারই এমন হয়। কিন্তু এই মন খারাপ লাগা ফেসবুকে শেয়ার না করাই ভালো।
ফেসবুকে তোমার মন খারাপের অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে তুমি কখনো শান্তি পাবেনা ভাই, জেনে রেখো। জানি ভাই তোমার বুকে অনেক কষ্ট। লাল কষ্ট নীল কষ্ট। মাল্টিকালারের কষ্ট। বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসে ভরা কষ্টগুলোর কথা ফেইসবুকে শেয়ার করে তুমি হয়তো নিজেকে কিছুটা হালকা করতে চাচ্ছো। কিন্তু ভাই এভাবে শান্তি পাওয়া যায়না। আমি পাইনি, কেউ কখনো পাইনি, তুমিও পাবেনা।
এরচেয়ে বরং তুমি সবর করো। ব্যথিত হৃদয়ে আল্লাহকে স্মরণ করো। মনের কথাগুলো, কষ্টগুলোর কথা তাঁকে বল যিনি এ অবস্থা বদলাতে পারবেন। যিনি এ সবরের বিনিময়ে তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। যাদের হৃদয় ভেংগে যায়, তাদের সাথে আল্লাহ থাকেন। তোমার সৃষ্টিকর্তাকে খুলে খুলে দেখাও তোমার মনের সব দুঃখ গুলো। একাকীত্বে, নির্জনতায় কুরআনকে তোমার সংগী বানাও। কান পেতে শোনো তোমার রব তোমাকে কী বলছেন।
দেখ ভাই, আল্লাহ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বান্দাদের সবচেয়ে বেশি কষ্টের, সবচেয়ে বেশি ফিতনাহর মধ্যে ফেলেন। ইউসুফ (আঃ) এর কথা ধরো, দাদা নবী ছিলেন, বাবা নবী, নিজেও নবী হবেন। নবীরা নিষ্পাপ। কোনো দোষ ছিলনা তাঁর। হিংসুক ভাইয়েরা খেলতে যাবার নাম করে ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দিল জংগলের ধারে নির্জন অন্ধকূপে। নিজের ভাইদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে সেই অন্ধকার কূয়ার তাঁকে পড়ে থাকতে হলো অনেক সময়। তখন তাঁর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করো। আপন লোকদের হাতে প্রতারিত হলে কেমন কষ্ট লাগে!
তারপর দাস হিসেবে তাঁকে বিক্রী করে দেওয়া হল মিশরের আযিযের কাছে। আযিযের স্ত্রী ইউসুফের (আঃ) রূপে মুগ্ধ হয়ে গেল। অভিজাত,সুন্দরী সবচেয়ে বড় কথা, কৃতদাস ইউসুফের (আঃ) মালিকের স্ত্রী, ইউসুফকে (আঃ) জিনার আহ্বান করল। নির্জন কক্ষে ইউসুফকে (আঃ) সাথে নিয়ে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিল।
আযিযের স্ত্রী জুলায়খা-রূপবতী,লাস্যময়ী,অভিজাত। নির্জন কক্ষ। হাতছানি দিয়ে একজন সুন্দরী নারী, যুবক ইউসুফ (আঃ) কে এমন এক কাজের জন্য আহ্বান করছে যা যেকোনো পুরুষের স্বপ্ন। পরম আরাধ্য বিষয়। ভাই, তুমি আমি কী এই ফিতনাহর মাঝে পড়েছি? তখন ইউসুফের (আঃ) মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করো একবার। কী ঝড় চলছিল তাঁর মনে!
সবাই জানতো জুলেয়খা যা বলছে তা মিথ্যে। ইউসুফ (আঃ) নিষ্পাপ, নিরাপরাধ। যিনার হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি বন্ধ দরজার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন, জুলায়খা পেছন থেকে তাঁর (আঃ) জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল তারপরেও ইউসুফ (আঃ) কে দিয়ে জিনা করাতে পারেনি। কিন্তু তারপরেও জিনার অপবাদ মাথায় নিয়ে তাঁকে কারাগারে কাটাতে হলো সুদীর্ঘ সময়। তুমি কি ইউসুফের (আঃ) চাইতেও বেশি ফিতনাহ, বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছো?
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা চিন্তা করো। তাঁর চেয়ে আল্লাহর নিকট আর প্রিয় ব্যক্তি কে ছিলেন? অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেও কতো কষ্ট করতে হয়েছে। বাবাকে জীবনে চোখেও দেখেননি, মমতাময়ী মাকে হারিয়েছেন ছয় বছর বয়সেই। পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, নিজের লোকেরা এলাকা থেকে উচ্ছেদ করেছে, মাসের পর মাস চলে গিয়েছে চুলায় আগুন জ্বলেনি, খেজুর খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে, নিজ হাতে একে একে কবরে শুইয়েছেন প্রিয়তম সন্তানদের, বন্ধু আর প্রিয়মানুষদের। কাফির মুশরিকদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপতো আছেই।
আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়মানুষ, সবচেয়ে শুদ্ধ আত্মাকে যদি এতোটা কষ্ট করতে হয়, তাহলে তুমি আমি কেন একটু কষ্ট সহ্য করতে পারবনা?
ভাই, আল্লাহর শোকর আদায় করো। আল্লাহ তোমাকে দ্বীনের বুঝ দিয়েছেন। হাত বাড়ালেই তুমি হারাম রিলেশনের নাগাল পেয়ে যেতে, লিটনের ফ্ল্যাটে গিয়ে নিজেকে শান্ত করতে পারতে। ফিতনায় ভরপুর এই জমানায়ও আল্লাহ তোমাকে কলুষতা থেকে দূরে সরিয়ে পবিত্র রেখেছেন, বা কলুষতার জীবন ছুঁড়ে ফেলে ফিরে যেতে হবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে – এই বোধ তোমার মধ্যে রেখেছেন। এটি এক বিশাল নিয়ামত! কতো ছেলে অন্ধকার কানা গলিতে সদর্পে হেঁটে বেড়াচ্ছে, মদ, গাজা,ইয়াবা, উদ্দাম যৌনতায় ডুবে আছে আপাদমস্তক। ভুলেও বুঝতে পারছেনা বা চাইছেনা কী ভুল তারা করছে। তুমি তো অন্তত তাদের চাইতে ভালো আছো। নিজের চাহিদা হালাল উপায়ে পূরণ করতে চাচ্ছো।
আল্লাহ (সুবঃ) তো এই কষ্টের মধ্যে ফেলে তোমাকে সম্মানিত করছেন। মুসলিমের জীবন যদি সুখ আর স্বাচ্ছ্যন্দ্যে পার হয়, যদি কোনো দুঃখ কষ্ট না আসে, কোনো পরীক্ষা না আসে তাহলে অন্তরের ঈমান, অনুসৃত পথ নিয়ে সন্দিহান হবার সময় চলে আসে। দুনিয়ার জীবনতো মুমীনের জন্য এক কারাগারের জীবন। কারাগারের জীবনে কী দুঃখ কষ্ট পরীক্ষা থাকবেনা, বলো?
এ পথ তো সেই পথ! যে পথে চলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন আদম। ক্রন্দন করেছিলেন নূহ। আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ। যবেহ্ করার জন্য শোয়ানো হয়েছে ইসমাইলকে। খুব স্বল্প মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল ইউসুফকে, কারাগারে কাটাতে হয়েছিল জীবনের দীর্ঘ কয়েকটি বছর। যবেহ্ করা হয়েছে নারী সংশ্রব থেকে মুক্ত ইয়াহইয়াকে। রোগে ভুগেছেন আইয়ূব। দাউদের ক্রন্দন, সীমা অতিক্রম করেছে। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন ঈসা। আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম। নানা দুঃখ-দুর্দশা, কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করেছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ। আর তুমি এখনও খেল-তামাশায় মত্ত?! [১]
আর তুমি সেই পথে হেসেখেলে চলবে, ক্ষতবিক্ষত হবেনা তোমার হৃদয়, রক্তাক্ত হবেনা তোমার পা, তা কী করে হয়?
তুমি কি ভাবছো, আল্লাহ (সুবঃ) তোমাকে ভুলে গিয়েছেন? তুমি যে এতো দুঃখ,কষ্ট ভোগ করছো, তা আল্লাহ দেখছেননা? ভাই কাবার রবের কসম। আল্লাহ তোমাদের এই কষ্টের উত্তম প্রতিদান দিবেন। এমন উত্তম প্রতিদান যা তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা।
‘ সেই মুমিনরাই সফল, যারা তাঁদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে’ (সূরা মুমিনুন,আয়াত ১ও ৪)
নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম, নিশ্চয় তারাই হল সফলকাম। (সূর মুমিনূন : ১১১)
আল্লাহর কাছে সফলতার মানে কী?
সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। (সূরা আলে ইমরান : ১৮৫)
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তো তোমাকে জান্নাতের গ্যারান্টি দিয়েছেন। বলেছেন- ‘‘যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহবা) এবং দু’ পায়ের মধ্যখানের (লজ্জাস্থান) হেফাযতের গ্যারান্টি দিবে, আমি তার জান্নাতের ব্যাপারে গ্যারান্টি দেব’’। [বুখারী]
ভাই, এগুলো আল্লাহর চিরন্তন ওয়াদা – আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি ওয়াদা রক্ষাকারী।
যারা সবর করে, যারা পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যায়, নির্জন মুহূর্তে আল্লাহ্কে ভয় করে, যারা যৌবনের হেফাযত করে, আল্লাহর ইবাদাতে নিজেদের যৌবন পার করে দেয় আল্লাহ তাঁদের ওপর ভোরের শিশিরের মতো রহমত বর্ষণ করেন।
ইউসুফ (আঃ) এর কথায় ধরো। ভাইদের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হওয়া, কূয়াতে নিক্ষেপ, নারীদের ফিতনা, বন্দীত্ব এতোসব ফিতনাহর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।সবর করেছেন।আল্লাহর ওপর আস্থা হারাননি। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাকে মিসরের রাজত্ব দান করেন। অথচ তিনি মিসরে প্রবেশ করেছিলেন একজন ক্রীতদাস হিসেবে।আল্লাহ (সুবঃ) এই দাসকেই দিলেন সুবিশাল রাজত্ব। ক্রীতদাসের মাথায় পরিয়ে দিলেন সম্মানের মুকুট। [২]
মুসা (আঃ) ফিরাউনের ভয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। ক্ষুধার্ত, সহায় সম্বল, আশ্রয়হীন। একদিন কুয়োর ধারে এক গাছের নিচে বসেছিলেন। খেয়াল করলেন, সেখানে দুইজন মেয়ে পুরুষদের ভীড়ের কারণে তাদের পশুদের পানি পান করাতে পারছেনা। মুসা (আঃ) তাদের সাথে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে কথা বললেন। অত্যন্ত শালীনতার সাথে তাঁদের সাহায্য করলেন। এই শালীনতাবোধ, এই লজ্জাবোধের পুরষ্কার হিসেবে তিনি কি কি পেলেন?
সহায় সম্বলহীন, ক্ষুধার্ত মুসা (আঃ) আল্লাহর নবী শোয়াইব (আঃ) এর মেয়েকে পেলেন নিজের স্ত্রী হিসেবে। কাজ জুটলো। জুটলো নিরাপদ আশ্রয়।
৫০ হাজার বছর ধরে বিচার চলবে হাশরের ময়দানে। সূর্য থাকবে মানুষের অতি নিকটে। মাথার আড়াই হাত ওপরে। সূর্য আমাদের থেকে কতো কোটি কিলোমিটার দূরে। তারপরেও তার তাপে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাই। হাশরের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা চিন্তা করো। সূর্য থাকবে মানুষের মাথার খুব কাছে। সেদিন কী দুরাবস্থায় পড়তে হবে মানুষদের। ঘামের সাগরে মানুষ হাবুডুবু খাবে, তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাবে, ছায়া মিলবেনা। আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবেনা। আল্লাহ (সুবঃ) সেই আরশের ছায়ায় দয়া করে যাদের আশ্রয় দিবেন তাদের একজন হলো সেই যুবক যার যৌবন কেটেছে আল্লাহ্র ইবাদাতে, যাকে পরমাসুন্দরী অভিজাত মহিলার জিনার আহ্বান ফিরিয়ে দিয়ে বলে আমি আল্লাহ্কে ভয় করি।
ভাই, হতাশ হয়োনা। যুগে যুগে যারা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করেছে, আল্লাহ তাঁদের এই দুনিয়াতে দু’হাত ভরে দিয়েছেন। আর ওপারের ঐ জীবনটার পুরষ্কারের কথা তো বলায় বাহুল্য। তুমি কি মনে করছো, যেই আল্লাহ ইউসুফকে (আঃ), মূসাকে (আঃ) তাঁদের শালীনতাবোধ, পবিত্রতার জন্য এতো এতো নিয়ামত দিয়েছেন সেই একই আল্লাহ কি তোমাকে বঞ্চিত করবেন? তোমাকে চিরকাল দুঃখ,কষ্ট ভোগ করাবেন? কক্ষনোই নয়। ভাই, কক্ষনোই নয়।
আল্লাহ (সুবঃ) অচিরেই তোমাকে সুসংবাদ দান করবেন। এমন একজন মানুষের সঙ্গে তোমার জোড়া বেঁধে দিবেন যাকে দেখে তোমার চোখ শীতল হবে এবং তোমাকে দেখেও যার চোখ শীতল হবে। তোমাকে সকল ফিতনাহ থেকে রক্ষা করবেন। এই দুনিয়ায় তোমার ঘরেই নামিয়ে আনবেন জান্নাত। তোমাকে সম্মানিত করবেন। দাঁতে দাঁত চেপে আর কয়েকটা দিন লড়ে যাও ভাই। আমাদের জান্নাত ভাই, এই সামনেই।
আর মাত্র কয়েকটা দিনের দূরত্ব।
“কষ্টের সাথেই স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে”। (সূরা ৯৪: আয়াত ৫-৬)
“অচিরেই তোমার রব্ব তোমাকে এমন অনুগ্রহ দান করবেন যাতে তুমি সন্তুষ্ট হবে”। (সূরা দুহাঃ আয়াত ৫)