পদ্যখানা কোন কবি লিখেছেন, জানিনা। যে উদ্দেশ্যেই লিখে থাকুন, আমি কথাটার সাথে কয়েকশো ভাগ একমত।
যদি মসজিদকে মন্দিরের কাতারে নামিয়ে আনা হয়, তবে সেই মসজিদের তো আসলেই জাগতিক কোনো ভূমিকা নেই। মন্দির পুরোদস্তুর একটা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান, জাগতিক ভূমিকা শূন্য বা ঊনশূন্য। মান্নত, পার্থিব উদ্দেশ্য পূরণের জন্য মনের সান্তনা, পার্বণের আনুষ্ঠানিকতা। এখন মসজিদও তা-ই। সংখ্যাগুরু মুসলিম সপ্তাহান্তে হাজিরা দেয়। মুষ্টিমেয় মুসলিম ৩ ওয়াক্ত। এক চিমটি মুসলিম ৫ ওয়াক্ত আধ্যাত্মিকতাহীন উঠবস করে আসে। হাতেগোনা কিছু মানুষ আধ্যাত্মিকতার খোঁজ পায় এখানে এসে। একটাই জাগতিক ভূমিকা হতে পারত, জুমুআর পূর্বে আধঘণ্টা জনসংযোগ। ওটুকুও সময় কই, সবাই আসে আরবি খুতবার মাঝে।
বিজ্ঞানের কাজই জাগতিক। প্রকৃতিবাদ-কে ধর্ম হিসেবে মেনে নেয়া বিজ্ঞানের সামনে খোদ স্রষ্টা এলেও বিজ্ঞান মুখ ফুটে বলতে পারবে না, ইনি স্রষ্টা। সে রাস্তা শুরুতেই বন্ধ করে নিয়েই বিজ্ঞান হাঁটে। প্রতিটি বিষয়ের জাগতিক ব্যাখ্যা দেবার মধ্যেই বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ। বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা। তার চোখে মন জাস্ট কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া। পৃথিবী-আমি-আপনি সব উদ্দেশ্যহীন এবং পরিণতিহীন। যা কিছু বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না, তা বিজ্ঞানের চোখে কুসংস্কার। মহামারি একটা ইহজাগতিক বস্তুগত বিষয়। সুতরাং, বিজ্ঞান এখানে কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এখানে আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা থাকবে না, এটাও স্বাভাবিক।
"মনে রেখো তুমি, বিশ্বকাপের আঙিনায়
শচীন মেরেছিল ছক্কা, লতা মুঙ্গেশকর নয়"।
কবিতাটা হয়ে গেছে এরকম। আমার পয়েন্ট হল, যদি মসজিদ-মন্দিরকে 'স্পিরিচুয়াল বীল্ডিং' ক্যাটাগরিতে ফেলেন, ইসলাম-হিন্দুধর্মকে 'ধর্ম' হেডিং-এ ফেলে বলেন, মহামারিতে ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই। গুড, সহমত।
এবার আসেন। হিন্দুধর্ম 'অজানা-উৎস' থেকে হাজার বছরের মানবসমাজের সৃষ্টি। আর ইসলাম ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও নির্দিষ্ট উৎস থেকে আগত। টেক্সট প্রজন্মান্তরে সুরক্ষিত। সরাসরি স্রষ্টার প্রত্যাদেশ ও বিধান। আপনি বলবেন, সেটা তো হিন্দুধর্মও দাবি করে। কার দাবি সত্য, কারটা মিথ্যা, এটা ভিন্ন আলাপ। হিন্দুধর্ম কিছু আধ্যাত্মিকতা, নীতিকথা ও সামাজিক অনুষ্ঠানের সমষ্টি। বিপরীতে ইসলাম টোটাল একটা সিস্টেম। আধ্যাত্মিকতা মেইন সফটওয়্যার; সাথে নীতিকথা-ব্যক্তিক লাইফস্টাইল, পরিবার কাঠামো, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্রচিন্তা, স্বাস্থ্যনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও সমরনীতি, বিচারব্যবস্থা ও দর্শন। ইসলাম ধর্ম নয়, ধর্ম ইসলামের একটা অংশ। ইসলাম ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মিলিয়ে টোটাল সিস্টেম। এখন ইসলামের হাত-পা ছেঁটে দিয়ে আপনি বলছেন, ইসলাম দৌড়তে পারেনা। সব জাগতিক কর্মকাণ্ড, জাগতিক বিষয়াবলীর সাথে ইসলামের সব সম্বন্ধ আপনি 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র কাঁচি দিয়ে চেঁছে এখন এসেছেন মহামারিতে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই কাব্য নিয়ে।
ইসলাম তো বলেছিল, রোগ (pathogenesis) সংক্রামক নয়; রোগের কারণ (pathogen) সংক্রমণ-ক্ষম। তাই:
১. সুস্থ উট আর অসুস্থ উট একসাথে রেখো না। (social distance)
২. মহামারি উপদ্রুত এলাকায় যেওনা, মহামারির এলাকা থেকে বের হয়ো না, মরে গেলে শহীদের ভিআইপি মর্যাদা পাবে ওপারে (lockdown)
এই শিক্ষাটা তো আপনারা আমাদের শেখাতে দিলেন না। ইটালি-প্রবাসীদের শেখাতে ব্যর্থ আপনাদের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। নারায়ণগঞ্জের অধিবাসীরা জলপথে ত্যাগ করছে নিজ জেলা, আপনার সেক্যুলার শিক্ষা ব্যর্থ। আর ইসলামকেও আপনি শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব দেননি। আবার দায়ীও করছেন। বেশ।
মসজিদ তো আসবাবপত্রহীন এক বিরাট রুম। পিপিই, ভেন্টিলেটর, ভ্যাক্সিন রিসার্চ আধুনিক যন্ত্রপাতির নাভিশ্বাস উঠে গেছে, সেখানে মহামারিতে কী ক্ষমতা থাকতে পারে একটা খালি রুমের? যে রুমটার শিক্ষা কার্যক্রম কেড়ে নিয়েছেন, বিচারকার্য কেড়ে নিয়েছেন, বাজার-নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছেন, প্রশাসনিক কার্যক্রম ছিনিয়ে নিয়েছেন, সমাজচর্চা কেড়ে নিয়েছেন। এখন বলছেন জাগতিক কোনো ভূমিকা নেই। যে রুমটা সুশিক্ষিত, আত্মসংযমী সোনার মানুষ তৈরি করত তার হাত-পা বেঁধে দিয়ে দুর্নীতিবাজ-লোভী পুঁজিবাদী মানুষ তৈরির কারখানা বানিয়ে এখন এসব ন্যাকামো, পারেনও বস।
দিন বদলাবে। সেক্যুলার সংসদে তওবা হয়েছে। করোনার বহুরূপী রঙবদলে দিশেহারা বিজ্ঞান অপেক্ষা করছে একটা 'মিরাকেল'-এর। WHO জানিয়ে দিয়েছে, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার সম্ভব না-ও হতে পারে। নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা হাতছানি দিচ্ছে। কী সেটা, সেটা নিয়ে আপনারা অনিশ্চিত, অস্থির। আমরা নিশ্চিত, কী হবে তা আমরা জানিই, আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিশ্বাস এমন একটা ইন্দ্রিয়, এটা যার আছে, সে চিরটাকালই স্থির, শান্ত, নিশ্চিন্ত।