০৮। সূরা আনফাল, আয়াত ৪১ থেকে ৭৫

গনীমতের মাল বণ্টনের নিয়ম বর্ণিত হয়।

বদরের দুই দল আলোচনা করে যুদ্ধের তারিখ ঠিক করতে গেলে উভয় দলই মতভেদ করত। আল্লাহ তাঁর নির্ধারিত সময়েই যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছেন। যেন যাদের ধ্বংস হওয়ার, তারা সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেই ধ্বংস হয়; আর যাদের বেঁচে থাকার, তারাও সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেই বেঁচে থাকে।

আল্লাহর ইচ্ছায় উভয় দল পরস্পরকে চোখের দেখায় কম সংখ্যক দেখছিল। ফলে মুমিনদের সাহস বাড়ে, আর কাফিরদের অহংকার ও অসাবধানতা বাড়ে।

যুদ্ধের সময় অধিক যিকির করতে এবং কুরআন সুন্নাহর অনুগামিতা করতে বলা হয়। অন্তঃকলহ করতে নিষেধ করা হয়। কাফিরদের মতো অহংকারের সহিত লোক দেখানো ধাঁচের যুদ্ধ মহড়া না করতে বলা হয়।

শয়তান কাফিরদেরকে যুদ্ধের ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিয়েছিল। ময়দানে এসে ফেরেশতাদের দেখে সে তার বন্ধু কাফিরদের ফেলে পলায়ন করে।

কুরাইশ মুশরিকদের ফিরআউনের সাথে তুলনা করা হয়। উভয় অহংকারী দলই শক্তি ও সংখ্যায় বেশি হয়েও লাঞ্ছিত হয়েছে। এটা তাদের নিজেদেরই দোষ। কাফিররাই আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জীব।

চুক্তি ভঙ্গকারী শত্রু জাতি ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে সমুচিত আচরণ করতে বলা হয়।

জানা-অজানা শত্রুদের মনে ভীতি সঞ্চার করার লক্ষ্য মুমিনদের যথাসাধ্য সামরিক শক্তি অর্জন করতে বলা হয়। আর কোনো শত্রুজাতি শান্তিচুক্তি করতে চাইলে তা করতে বলা হয়। এটা করে তারা যদি ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তা উন্মোচন করার জন্য আল্লাহ আছেন।

প্রচণ্ড গোত্রীয় চেতনাবাদী আরব সমাজে আল্লাহ কীভাবে মুমিনদের মাঝে দ্বীনি সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন তা স্মরণ করানো হয়।

প্রাথমিকভাবে মুসলিম ও কাফিরের যুদ্ধ শক্তির অনুপাত ১:১০ হলেও যুদ্ধ ছেড়ে পলায়ন না করে যুদ্ধ করতে বলা হয়, এতেই মুসলিমরা আল্লাহর ইচ্ছায় সফল হবে। পরে বিধান সহজ করে ১:২ করা হয়।

শত্রুর শক্তি একেবারে চূর্ণ করার আগ পর্যন্ত তাদের হত্যা না করে বন্দী করা আল্লাহর পছন্দ নয়। বদরের বন্দীদের হত্যা না করে মুক্তিপণ আদায় করার কারণে আল্লাহ কড়া ধমকি দেন। কিন্তু সেই সাথে মাফও করে দেন এবং যা অর্থ অর্জিত হয়েছে, তা নিশ্চিন্তে ভোগ করার অনুমতি দেন। আর সেসকল কাফিরদের অন্তরে যদি আল্লাহ ঈমান আনার ইচ্ছা দেখেন, তাহলে তাদের এই মুক্তিপণ বাবদ সম্পদের ক্ষতিকে তিনি এর চেয়েও উত্তম জিনিস দিয়ে ক্ষতিপূরণ করে দিবেন।

যারা তখনও হিজরত করেনি, তাদের সাথে সম্পদের উত্তরাধিকারের বিধান এবং কাফির গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের সহায়তার বিধান বর্ণিত হয়।

যাঁরা ঈমান আনার পর হিজরত ও জিহাদ করেছেন এবং যাঁরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন (আনসার), তাঁদেরকে সাচ্চা মুমিন আখ্যায়িত করে ক্ষমা ও উত্তম রিযিকের ওয়াদা করা হয়।

০৯। সূরা তাওবাহ, আয়াত ১ থেকে ৯২

সূরা তাওবাহর বক্তব্য অনেকটা সূরা আনফালের মতোই। আরবের অনেক লোক মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি দেখার অপেক্ষায় ছিল। মুসলিমদের মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধ জয়ের পর সমগ্র আরবের এসব লোকদের ইসলাম গ্রহণের পথে আর বাধা রইল না। এমতাবস্থায় আরব উপদ্বীপকে ইসলামের কেন্দ্র ঘোষণার্থে সেখানে অমুসলিমদের স্বাধীন নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যুদ্ধরত নয় এমন মুশরিকদের যাদের সাথে এমন চুক্তি ছিল যার মেয়াদ নির্ধারিত হয়নি, তাদের চার মাস সময় দেওয়া হয়। এর মাঝে ইসলাম গ্রহণ না করলে আরব উপদ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে। আর যাদের সাথে মেয়াদ নির্ধারিত আছে, তাদের সাথে মেয়াদ পূর্ণ করা হবে। তারপরও তারা মুসলিম না হলে বা আরব উপদ্বীপ ছেড়ে না গেলে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই হত্যা করা হবে। এসকল মুশরিকেরা মুসলিমদের বাগে পেলে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক বা ন্যায়-অন্যায়ের মূল্য দেয় না। তাদের সাথে অনুরূপ আচরণের হুকুম করা হয়। তারপর কিছু শর্ত বর্ণিত হয়, যেখানে তাদের হত্যা না করে নিরাপত্তা দিতে হবে। যেমন- ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হওয়া।

মুশরিকরা কাবার রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে গর্ব করত। মূর্তিপূজকরা যে এ দায়িত্বের অযোগ্য, তা ঘোষণা করা হয়।

আত্মীয়-ঘরবাড়ি-সম্পদের চেয়ে জিহাদকে অধিক ভালোবাসতে বলা হয়। আপন আত্মীয়ও যদি কাফির হয়, তাদেরও অভিভাবক বানানো যাবে না।

হুনাইনের যুদ্ধের দিন মুসলিমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্য দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলো। ফলে প্রাথমিকভাবে পরাজয় বরণ করে। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের পুনঃসংগঠিত করে আক্রমণের সুযোগ দিয়ে বিজয় দেন। এই নিয়ামাতের কথা স্মরণ করানো হয়।

আহলে কিতাবগণের ওপর জিযিয়ার বিধান আরোপ করা হয়। তাদের ভ্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো তিরস্কার করা হয়। যেমন- আল্লাহর সন্তান আছে বলে বিশ্বাস করা এবং পীর-দরবেশদেরকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা। তাদের অন্যায়ভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করার কাজকেও তিরস্কার করা হয়।

মুশরিকরা নিজ সুবিধার্থে পবিত্র মাসসমূহ আগপিছ করে বছর হিসাব করত। এটিকে তিরস্কার করা হয়।

এরপর রোমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিতব্য তাবূক যুদ্ধের বিভিন্ন দিক বর্ণনা শুরু হয়। সংখ্যার স্বল্পতা, আসবাবের অভাব, বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও জিহাদে বের হতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়।

মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়। জিহাদের ইচ্ছা যদি তাদের থাকতই তাহলে কিছু না কিছু প্রস্তুতি নিত। কিন্তু তারা জিহাদে গেলে বিশৃঙ্খলাই করবে। তাই আল্লাহই তাদের ঘরে বসিয়ে রেখেছেন।

তারা অনেকে আজগুবি সব অজুহাত দিত। এক মুনাফিক আরজ করেছিল রোমান নারীদের দেখলে সে ফিতনায় পড়ে যাবে, তাই তাকে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক। আল্লাহ বলেন জিহাদে না গিয়ে বসে থাকাটাই ফিতনা।

মুসলিমদের ওপর বিপদ এলে মুনাফিকরা ভাবে যে তারা বেঁচে গেল। অথচ তাকদিরে থাকা বিপদ আসবেই। মুমিনরা তো হয় জয়ী হবে নয়তো শহীদ হবে, আর মুনাফিকরা হয় আল্লাহর হাতে সরাসরি বা মুমিনদের হাত দিয়ে শাস্তি পাবে।

তারা কেউ কেউ টাকা দিয়ে শারীরিক জিহাদ থেকে অব্যাহতি চায়। আর মুমিনদের মধ্যে কেউ সদকা দিলে তাকে লোক দেখানো বলে উপহাস করে। কেউ দারিদ্র্যের কারণে কিছু দিতে না পারলে তাকেও উপহাস করে। আল্লাহ বলেন মুনাফিকদের দানই বরং কবুল হয় না। মুমিনরা ঠিকই সাওয়াব পায়।

যাকাতের খাতসমূহ বর্ণিত হয়।

রাসূল (সাঃ) সকলের কথা বিশ্বাস করেন, এমন মন্তব্য করে মুনাফিকরা খুশি হয় এই ভেবে যে তাঁকে তারা সহজেই প্রতারিত করছে।  আল্লাহ এই ধারণা খণ্ডন করে দেন যে তিনি তাঁর রাসূলকে ঠিকই সব গোপন চক্রান্ত জানিয়ে দেন।

নিজেদের মুসলিম দাবি করার পরও মুনাফিকরা কাফিরসুলভ কথাবার্তা বলে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঠাট্টা করছিল। এটাকেও কুফরি আখ্যায়িত করা হয়।

মুনাফিক নারী-পুরুষদের তিরস্কার করে তাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের সীমালঙ্ঘনকারীদের সাথে তুলনা করা হয়। মুমিন নারী-পুরুষদের প্রশংসা করে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়।

কাফিরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে মৌখিক জিহাদ করতে বলা হয়। তাদের প্রতি কঠোর হতে বলা হয়।

গরমের ভয়ে জিহাদ না করতে চাওয়ার মানসিকতা খণ্ডন করে বলা হয় জাহান্নাম এরচেয়েও উত্তপ্ত।

মুনাফিকদের মৃত্যুতে জানাযা পড়তে রাসূলকে (সাঃ) নিষেধ করা হয়।

মুনাফিকরা যারা জিহাদে যেতে চায় না আর মুমিনদের যারা সামর্থ্য না থাকায় জিহাদে যেতে পারে না, তাদের পার্থক্য দেখানো হয়। শেষোক্ত দলের কোনো দোষ নেই।

কাফির-মুনাফিকদের সম্পদের প্রাচুর্য বরং তাদের প্রতি আযাব। এগুলো তাদেরকে কুফরে অটল রেখে কুফরির ওপরই মৃত্যুবরণ করায়।