অমুসলিম লেখকদের ইসলাম নিয়ে লেখা বইপত্র পড়তে সাধারণ মানুষকে আলেমরা নিষেধ করেন। তারা বলেন, অমুসলিমদের লেখা বইপত্র গবেষকদের টেবিলে থাকবে। তারা এগুলো পড়বেন, পর্যালোচনা করবেন। সাধারণ মানুষের জন্য এসব নাড়াচাড়া করা বিপদজনক। আলেমদের এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে মোটাদাগে দুটি কারণ থাকে।
১। অমুসলিম লেখকদের লেখায় ইসলামের মূল আবেদন ও ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। ভাষার চমক দিয়ে সুক্ষ্মভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় বিষ। পাঠকের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয়। এই বিষয়গুলো এতটাই স্পষ্ট যা বিস্তারিত আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের লেখা পড়লে যে কেউ এর সত্যতা পাবেন।
২। প্রথম বিষয়টি সহজে বুঝে আসে। কিন্তু আরেকটি বিষয় আছে, যা সহজে আমরা ধরতে পারি না। অনেক সময় আমরা বলি, অমুক বইতে তথ্যগত কোনো সমস্যা নেই। তিনি অমুসলিম লেখক হলেও লেখায় সততা বজায় রেখেছেন। ভুল কোনো তথ্য দেননি।
অমুসলিম লেখকদের লিখিত বইয়ের বিশাল ভান্ডারে এমন বইয়ের সংখ্যা যে খুবই কম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অল্পকিছু বইও সাধারণ মানুষের পড়া উচিত নয়। বিষয়টি অযৌক্তিক মনে হতে পারে, কিংবা মনে হতে পারে বাড়াবাড়ি। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টির যৌক্তিকতা বুঝে আসবে।
৩। একজন মুসলিম লেখক যে দৃষ্টিতে ইসলামকে ব্যখ্যা করেন, ইসলামের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেন, একজন অমুসলিম লেখক কখনোই তা করবেন না। একজন মুসলিম লেখক তার লেখায় আকিদাকে প্রাধান্য দিবেন, লেখার ছত্রে ছত্রে নিখাদ ইসলামি চেতনা ফুটিয়ে তুলবেন, প্রকারান্তরে একজন অমুসলিম লেখক কখনোই তা করবেন না। অমুসলিম লেখক তার লেখায় প্রাধান্য দিবেন বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও বিশ্লেষণকে। একটা উদাহরণ দেই-
বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার লিখিত গ্রন্থে ক্রুসেডের সময়কার একটি ঘটনা লিখেছেন। একবার বাইতুল মাকদিসের দিকে ক্রুসেডারদের বিশাল একটি বাহিনী এগিয়ে আসছিল। বাহ্যিকভাবে মুসলিম বাহিনীর শক্তি সামর্থ্য ছিল তাদের চেয়ে কম। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী খুব পেরেশান ছিলেন। বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ যখন ফজরের সময় মসজিদে গেলেন, তিনি দেখলেন সুলতান সেজদায় পড়ে আছেন। সুলতান যখন মাথা তুললেন, বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ দেখলেন সুলতানের দাড়ি ভিজে গেছে চোখের পানিতে, জায়নামাজের উপর টপটপ করে ঝরছে চোখের পানি। এরপর সুলতান আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। সেদিনই সংবাদ এলো ক্রুসেডার বাহিনীতে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তাদের সেনারা বিভিন্ন গ্রুপ হয়ে একেকদিকে চলে যেতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যে পুরো ময়দান ক্রুসেডার শূন্য হয়ে যায়।
মূল ঘটনা এটুকুই। কিন্তু একজন মুসলিম লেখক যখন এই বিষয়টি লিখবেন, তখন তিনি দেখাবেন, ক্রুসেডারদের এই দ্বন্দ্ব ছিল, মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা নুসরত। এটি ছিল সুলতানের দোয়ার প্রভাব। পাঠক এই লেখা পড়ে আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী হবেন। তিনি বুঝতে পারবেন, যত বড় সমস্যাই আসুক, আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি সমাধান করে দিবেন। এভাবে পাঠক ইতিহাসের একটি ঘটনা পড়ে সেখান থেকে অর্জন করবেন জীবনের পাথেয়। এই শিক্ষা তিনি কাজে লাগাবেন জীবনের বাঁকে বাঁকে।
অপরদিকে একজন অমুসলিম লেখক যখন এই ঘটনা লিখবেন, তিনি দেখাবেন ক্রুসেডারদের সরে যাওয়ার কারণ ছিল তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এরপর তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি আলোচনা করবেন। দোয়ার ফলাফল, কার্যকারিতা ও আল্লাহর নুসরতের বিষয়টি কিন্তু তার লেখায় আসবে না। আসবেই বা কেন, তিনি তো এতে বিশ্বাসই করেন না। তার লেখার এই অংশ পড়ে পাঠক কিছু তথ্য জানবেন, কিন্তু এখান থেকে তিনি নিজের জীবনের জন্য কোনো শিক্ষা বের করতে পারবেন না।
আলোচনা দীর্ঘ করা উদ্দেশ্য নয়। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। মূল কথা হলো, অমুসলিমদের লেখকদের সেইসব রচনা, যাতে বাহ্যিকভাবে তথ্য-উপাত্তে কোনো ভুল নেই, সেসব বই পড়েও সাধারণ মানুষের তেমন উপকার নেই। এখান থেকে তিনি শিক্ষা অর্জন করতে পারবেন না, বরং সবকিছুকে মাপবেন বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। অথচ একজন মুসলিমের পঠন-পাঠনের মূল উদ্দেশ্য নিজের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করা।
দুটো জিনিস দেখা গেল। অমুসলিম লেখকদের বইতে হয়তো তথ্য বিকৃতি থাকবে, আর তথ্য বিকৃতি না থাকলে তাতে লেখকের এমন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠবে যার সাথে ইসলামি চিন্তা ও চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা সাংঘর্ষিক। অমুসলিম লেখকদের বইতে হয়তো ক্ষতি থাকবে, আর ক্ষতি না থাকলেও লাভশূন্য থাকবে।
অথচ এর বিপরীতে রয়েছে মুসলিম লেখকদের বিশাল ইলমি ভান্ডার, যা থেকে নিরাপদে উপকৃত হওয়ার সুযোগ খোলা থাকছে। তাহলে একজন সাধারণ পাঠক কেন নিরাপদ পথ ছেড়ে বিপদসংকুল পথে হাঁটা শুরু করবেন কোনো প্রকার সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়া।
-
নতুন নতুন বইপত্র আসতেছে, আসবে। ব্রিটিশ লেখকের লেখা সালাহুদ্দিন আইয়ুবীকে নিয়ে একটি বই অনুবাদ করতে যাচ্ছে একটি প্রকাশনী। এমন আরো বইপত্র আসবে। সব বই ধরে ধরে রিভিউ করা সম্ভব নয়। অপরদিকে অনেক ভাইয়েরা এসব বইপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এজন্য মৌলিক দুটি কথা বলে দিলাম। ভাইয়েরা এই কথাগুলো মনে রাখবেন। বইপত্র কেনার ক্ষেত্রে আলেমদের সাথে পরামর্শ করে নিবেন।
মনে রাখবেন, ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রগুলো এতটা ইয়াতিম হয়ে যায়নি যে, কাফেরদের লেখা পড়ে আমাদের ইসলাম শিখতে হবে, উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনি জানতে হবে।
(এই কথাগুলো সে সকল মুসলিম লেখকদের জন্যও প্রযোজ্য যারা প্রাচ্যবিদদের দ্বারা প্রভাবিত, কিংবা সেক্যুলার মানস দ্বারা পরিচালিত)