আমার আরবী শেখার গল্প, খুব সংক্ষেপে বলি,

অনেকে অবাক হয় বাংলা শিক্ষিত মানুষ হয়ে কিভাবে আরবী শেখার সামর্থ (প্রকারান্তে সাহস) হলো। আর যেহেতু সবাই মিলে একটা বই কম্পাইল করা হয়েছে আর নাম গেছে কেবল আমার তাই অনেক মেসেজ আসে কি করে পারলেন! একটা বইয়ে এই গল্পটা লিখতে হবে বলে এখানেই বলে দিই। কারও চাহিদার জন্য লেখা কঠিন। তার চেয়ে বরং স্টাটাস লেখা অনেক সহজ।

আরবী শেখার প্রথম প্রচেষ্টা শেষ চিল্লার শেষের দিকে। ২০০৯ সাল। আমাদের জামাতে আমি ছিলাম আমীর আর আমার সাথে ছিল হাফেজ, মাওলানাগন। এর মধ্যে এক হাফেজ সাহেবকে বললাম আরবী শিখব। তিনি দোকানে নিয়ে গিয়ে কিছু বই কিনে দিলেন। মিজানুস সারফ সম্ভবত। আরেকটা কমলা রঙের ছোট বই। অতীব উতসাহে কিনিয়া লইলাম কিন্তু পড়িবার সাহস হইল না। পরে দেখব বলে সে যাবত প্রচেস্টার সমাপ্তি হইল।

চিল্লা থেকে ফিরে আরবী শেখার কথা ভুলে গেলাম। তখন হাতে নিয়েছিলাম তাফসীরে ইবনে কাসির। সমুদ্রের মধ্যে ঝাপ দেওয়ায় সাতার কাঁটা ব্যতিত আর অন্য কিছু করার সময় নাই। ইতোমধ্যে পরিচয় হল আই সিডির সাথে। এনাম চাচার দারুন ভক্ত বনে গেলাম। কি প্রখর চিন্তা-বুদ্ধিরে বাবা! তো ওইখানে দেখি আরবী পড়ায়! বাহ! কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। আমার অবশ্য ক্লাস বাদ দিয়ে ক্লাসের আগে পড়ে আড্ডাগুলোতেই বেশি মন। প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিলো। মদীনা বুক-১। হাযা কিতাবুন, হাযিহি মাকতাবাতুন। শায়খ আব্দুল মতিনের যত্নে গড়া ক্লাসগুলোতে বাধ সাধে ক্রিয়া। বিশাল এক চার্ট নিয়ে আসলেন যা আসলে তখনও বইতে আসেনি। ক্রিয়ার চার্ট। নাসারা, নাসারা~, নাসারু~ ওরে বাবা! আমার কাছে সবই নাসারা নাসারা মনে হয়। পার্থক্য করতে পারি না। ঐখানেই আদতে সেই প্রচেষ্টার ইতি ঘটেছিলো যদিও এর পরেও কিছু ক্লাস করেছি।

এরপর বিবাহ করলাম। বুঝতেই পারছেন। পড়াশুনা যা করতাম তার আর সময় পাইলাম না। অতঃপর একটা কন্যা সন্তানও হইল। আরবী শেখা তখন ইতিহাসের কাঠগড়ায়। ঐ সময় চাকরী থেকে বের হয়ে আসলাম। নাহ! জীবনটা এমন হতে পারে না।

সত্যি বলতে কী ঐ চাকরী ছাড়াটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ফুল টাইম চাকরি ছেড়ে পার্ট টাইম চাকরী নিলাম। সপ্তাহে তিন দিন। বাকী সময়? মতবিরোধ দেখে মাথা ঘুরতে থাকায় সবগুলো মত কম্পাইল করার চেষ্টা করলাম। সত্যি বলতে কি দ্বীনের যতটুকু শিক্ষা অর্জন করেছি তা ঐ চাকরি ছাড়ার বরকত। আরবী শেখার কথা আর মনে করতে পারি নাই।

অতঃপর ২০১৪ সাল। আগস্ট মাসে আমার অফিসের বসের এক বন্ধু আসলেন কাতার থেকে। উস্তায তারেক শাহরিয়ার। উনি একটা টেস্ট প্রজেক্ট করবেন। ৩৬ ঘন্টায় মদিনা বুক-১। ফজরবাদ সকাল সাতটা থেকে ৩ ঘন্টা করে ১২ দিন টানা। নাস্তা, বই খাতা কলম সব অফিস দেবে। আমাকে ডেকে বসরা বললেন করবা কী না। আমি ভাবলাম করা যায়। তবে আগের অভিজ্ঞতাতো ছিলোই। তবু দেখি ফ্রি তো!

পরদিন ফজরবাদ অফিসে গিয়ে দেখি খাতা কলম সব রেডি। বুড়া বুড়া ছাত্ররা আমরা। উস্তায শুরু করলেন। আমরাও শুরু করলাম। ইটস নাও অর নেভার। দ্যা লাস্ট চান্স! উনি বললেন আমরা শুনলাম। কেউ কেউ কান খাড়া রেখে ঘুমাইলো। কিন্তু এইবার যেন আমি ভিন্ন কেউ। যা পড়ায় তাই পারি। কী রে! একটা অক্ষর ছিলো না যা মাথায় ঢোকেনি। এবার বুঝি আল্লাহ চেয়েছেন। সুতরাং মজা পেয়ে গেলাম। ফজরের পর বাসায় না থেকে অফিসে গিয়ে বিশ্রাম নিতাম। বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুম যেন ক্লাস মিস না হয়। একদিন উস্তায এতো আগ্রহ দেখে খুব খুশি হলেন আর অনেক দোয়া করে দিলেন।

বারো দিন পরে। যা পরিয়েছিলো তা সুন্দর করে নোট করলাম। ওটাই কি আল-কুরআনের ভাষা বইয়ের প্রথম সংকলন? তখনও বুঝিনি সেটা। এরপর লোকেদের ডেকে বললাম আসো আমি তোমাদের আরবী শেখাবো! নিউ মার্কেট থেকে বড় একটা হোয়াইট বোর্ড, দাস্তার আর মার্কার নিলাম। ফজর বাদ নিজ বাসায় ক্লাস শুরু করে দিলাম। নাস্তা ফ্রি। পরাই আর খাওয়াই। তারা যে আমাকে ফ্রিতে উস্তায বানাই দিছে!

বুক-১ পরানো শেষ করলাম। বললাম বেশি প্রশ্ন করিও না। কারন আসলে আমিওতো এর বাইরে কিছু জানতাম না! এবার ওস্তায আর ছাত্রের দৌড় সমান। তাহলে? আমাকে আরও জানতে হবে। উস্তায শাহরিয়ার বলে গেলেন অনলাইনে একজন উস্তায আছে, দ্যা লিজেন্ড আসিফ মেহের আলী! আর অফলাইনে মোটিভেটর প্লাস উস্তায ইঞ্জিনিয়ার রেজা করিম।

আসিফ মেহের আলীর ভিডিওগুলো দেখতে লাগলাম। অসম্ভব ধৈর্য্যের কাজ। তবু দেখলাম। খাওয়ার টেবিলে, লঞ্চ যাত্রায়, বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে। বাদ নাই, সময় নাই। খাতা কলম নিয়ে খালি দেখতেই থাকলাম। প্রায় দেড় বছর। এর মাঝে বুড়া বয়সে আমাকে সময় দিলেন ওস্তায রেজা করিম। উনি আমাকে ক্রিয়ার বাঁধা দূর করতে বেশ সাহায্য করেছেন। ব্রিলিয়ান্ট টিচার। শুধু উনি না যাকে পাই তাকেই প্রশ্ন করি। মানুষকে বিরক্ত করে ছাড়তাম। আমার উস্তাযের সঠিক সংখ্যা আমি নিজেও জানি না। তবে এদের মধ্যে অনেক বেশি শিখিয়েছে নবীন উস্তায রেদওয়ান মাহমুদ আর উস্তায ইমরান হেলাল। আমার দুই নয়নের তারা।

এরপর আরও অনেক বই দেখেছি পড়েছি। যদিও কুরানীয় আরবীর বাইরে আমি তেমন কিছু জানি না। আরবী সাহিত্য পড়ার জন্য আমি আরবী শিখি নাই। সেটা পারিও না। স্রেফ কুরআন হাদিস বুঝে পড়তে পারব বলে আরবী শিখেছি। যতটুকু শিখেছি। লোকেরা উস্তায বলে। তবে ভুয়া উস্তায। তারাও জানে এটা। ভালোবেসে বলে আরকি। আমার ছাত্ররাই আমার সত্যিকারের উস্তায।

এখন আর আরবী পড়ি না। কারন আরবী শেখাই জীবনের সব না। দ্বীনকে জানা, মানা আর জনানোই সব। ভবিষ্যতে সময় পেলে আবার আরবী শেখা হবে ইনশা আল্লাহ। অসংখ্য কথা ছিলো বলা হলো না। এমনিই অনেক বড় হয়ে গেছে।

দুয়ার দরখাস্ত!


Wednesday, 16 October 2019 at 22:37