নিউরোটিক মা আর পাপেট ছেলে — এ ধরণের কম্বিনেশনের ছেলেদের দাম্পত্য বেশির ভাগ সময়েই হয় ডিভোর্স না হয় ‘নিয়ারিং টু ডিভোর্স’-এ গিয়ে ঝুলে থাকে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই নিয়ে একটা পার্মানেন্ট দূরত্ব তৈরি হয়। এতে করে পরবর্তীতে সে পরিবারের সন্তানেরা একটা কনফিউজিং স্টেটে বড় হয়। (মা দাদীকে দেখতে পারে না, দাদী মায়ের নামে পচা কথা বলে, মা বাবার সাথে রাগ রাগ থাকে, বাবা অনেক ধমক দেয় না হলে চুপচাপ থাকে। কিন্তু সবাইই তো আমাকে আদর করে!)। বাচ্চাটার সামনে তখন অনেকগুলো প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। বড়দেরকে কীভাবে শ্রদ্ধা করতে হবে? সংসারের কর্তৃত্বটা আসলে কার হাতে? বাবাকে কতটুকু রেস্পেক্ট করব?
এখানে আমি সন্তানদের সাইডটা টেনে নিয়ে আসলাম কারণ আমার অভিজ্ঞতা বলে বাঙালি দম্পতিরা সন্তানদের ভালো নিয়ে যতটা মাথা ঘামান নিজেদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে তার দশ ভাগের এক ভাগও মাথা ঘামান না। তাই এটা বোঝা খুব জরুরি, সুস্থ দাম্পত্য সুস্থ প্যারেন্টিং-এর চাবিকাঠি।
মা যদি শাশুড়ির/শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে মুখ খুলতে না পেরে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকেন, এক সময় আর সহ্য করতে না পেরে উনি সন্তানদের মারধোর শুরু করবেন, বা কাজের লোকদের অত্যাচার করবেন। আমাদের দুই জেনারেশন আগে দাদা দাদীদের আমলে ছেলেমেয়েদের পিটিয়ে মানুষ করার চল ছিল। স্কুলেও সেটা করা হতো। সে সময়ের মারের সাথে এখনকার মারের পার্থক্য হচ্ছে সে সময়ে বাচ্চাটার পৃথিবী অনেক বড় ছিল। মার খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে, কাঁদা মাখামাখি করে একটা পাখির বাচ্চা নিয়ে খেললেই হয়ে যেত। অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। দাদা দাদীরা যদি আমাদের বাবা মায়েদের পিটিয়ে বড় করেন, বাবা মায়েরাও আমাদের জেনারেশনকে মারধোর করেছেন, আমরা জেনে এসেছি মার দেয়া শাসন করার একটা স্বাভাবিক প্রসেস। কিন্তু আমাদের সন্তানদের পৃথিবীটা সীমাবদ্ধ টিভিতে, স্কুলে (যেখানে অনেক বাচ্চা গাদাগাদি করে পড়াশুনা করে, সুস্থ আনন্দ করার সুযোগ বেশি থাকে না), আর ঘরে। তার কিন্তু এই ফিজিক্যাল অ্যাবইউজের কষ্টটাকে ডিফিউজ করার জায়গা নেই। স্কুলে বাচ্চাদের মনের দিকে খেয়াল রাখার জন্য কোনো শিক্ষকের সময় নেই (যারা দেন তাঁরা বাড়তি সময় ম্যানেজ করে দেন, বেশি একটা করতে পারার কথা না)। সুতরাং যে বাচ্চাটা ফিজিক্যাল অ্যাবইউজে হিউমিলিয়েটেড হয়ে আসছে, সে ঘরে টেনশন বুঝতে পারবে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সেই মা-টা কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কারণে স্বামীর সাথে দূরত্বের অত্যাচারে জর্জরিত। সুতরাং সম্মান, নির্মল আনন্দ, খুশি, হাসি – এই জিনিসগুলি কিন্তু মা সেই বাচ্চাকে দিতে পারবে না। বাচ্চাটা দেখে আসছে মা সবসময় আপ্সেট, নয় মুখ ভার, নয় রাগ। একটু বড় হলে সে এটাও বুঝতে পারে এই রাগের কারণ সে একা না, অন্যরাও। সুতরাং খুব ছোট থেকেই সেই বাচ্চাটাকে অনেকগুলি অসহায় অবস্থাতে ফেলা হচ্ছে (মাকে ঠিক করি কীভাবে? বাবা আরেকটু মেশে না কেন? দাদীকে কেমন ভাবব?) এইসব ডিলেমা বড়দের ডিল করার কথা, ওই ছোট্ট বাচ্চাটার না।
ঘরে যদি বাচ্চাকে কেবল আদরই করা হয়, তাকে নিয়ে খেলা না হয়, তার বিভিন্ন ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া না হয়, তাকে স্টেপ বাই স্টেপ জিনিসগুলো শেখানো না হয়, বাচ্চা খুশি থাকবে না। বাচ্চা অনেকগুলো ভয় নিয়ে বড় হবে। তার মধ্যে ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি হবে। এবং সবচেয়ে ভয়ের কথা, সেই বাচ্চা নিজেও বড় হয়ে অ্যাবইউজার হবে।
অতএব, যদি নতুন বা হবু বাবারা ধরে নেন যৌথ পরিবারে থাকলেই বাচ্চাটা সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বড় হবে আর একক পরিবারে থাকলে স্বার্থপর হবে, ব্যাপারটা এত সরল না। বরং এভাবে চিন্তা করুন, একটি সুস্থ সম্পর্কের মধ্যে থাকলে বাচ্চাটা সম্পর্কের সৌন্দর্যকে সম্মান করে বড় হবে। যার যার পার্সোনাল বাউন্ডারি জানা থাকলে কখন সম্মানের সাথে বাউন্ডারি থেকে বের করে দিতে হয় সেটা শিখবে, এবং এতে করে পরবর্তীতে যেকোনো অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে চিনতে শিখবে। বড়দের প্রতি ছোটদের দায়িত্ব কী সেটা শিখবে। আর বড়রা যখন ভুল করে তখন সে ভুলটাকে ভুল হিসেবেই চিন্তা করবে, কনফিউজড হয়ে সেটাকে ঠিক মনে করা শুরু করবে না (যেটা নিউরোটিক মায়ের পাপেট ছেলেরা করে এসেছেন)।
অতএব, হবু সন্তানের খাতিরে হলেও দাম্পত্য ঠিক করুন। স্ত্রীর সাথে মায়ের বনিবনা না হলে একটু সময় নিয়ে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করুন। ধরে নিন আপনার স্ত্রী কোনোদিন বদলাবে না। এই অবস্থায় আপনি কি এই স্ত্রীকে নিয়েই সংসার করবেন? না করতে চাইলে সম্মানের সাথে তাকে বিদায় করুন, এবং পরবর্তী সঙ্গীকে স্পষ্ট করে আগে জানিয়ে নিন যে আপনার মায়ের এই সমস্যা আছে, আপনি স্ত্রীর থেকে কী আশা করেন আর সেটা না করতে পারলে আপনি সংসার করবেন না। যদি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে না চান, স্ত্রীর সাথে বসে বাউন্ডারি সেট করুন। ওর কোনো অভিযোগ অর্ধেক শুনে উড়িয়ে দেবেন না (কারণ যে কোনো কিছু সাপ্রেসড হয়ে থাকলে সেটা আপনার সন্তানের উপরে গিয়ে পড়বে)। যদি আপনার কাছে মনে হয়ও যে এগুলি ফালতু অভিযোগ, সময় নিন, বোঝার চেষ্টা করুন এসবের কারণে এত অসুবিধা হচ্ছে কেন। কুইক কোনো সমাধানে আসার চেষ্টা না করে বোঝার চেষ্টা করুন। মা যখন বউয়ের নামে বাজে কথা বলে আপনি যুক্তি দেন, এগুলি তো আমাকে এফেক্ট করে না। বলুক না? তাহলে উল্টোটাও হতে দিন, বউ মায়ের নামে বাজে কথা বলুক, ওটা তো আরও এফেক্ট করার কথা না, তাই না? দুই পক্ষকে সমান পরিমাণ জায়গা দিন, নিজের বায়াসটাকে ঢেকেঢুকে নিউট্রালি দুটো সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা করুন। শেষ পর্যন্ত একটা নেগোসিয়েশনে আসুন যেটা দুই পক্ষই মেনে নেবে।
আপনি যদি এই কাজগুলি সিন্সিয়ারলি করেন এবং আপনার স্ত্রী সেটা দেখতে পায়, আপনার স্ত্রীর মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ অনেকটাই দূর হবে। অন্তত সে আমার কোনো কথা শুনে না, সে মায়ের হাতের পুতুল – এসব লেবেলগুলি থেকে আপনি মুক্তি পাবেন। পুরো জিনিসটা মানসিকভাবে অসম্ভব পরিশ্রমের ব্যাপার, তাই ভালো উপদেশ দেন, জাজ করেন না, এমন কোনো মানুষের সাথে তখন নিয়মিত কথা বলুন। সেই মানুষটা বিপরীত লিঙ্গের না হওয়াই উত্তম।