ছোটকালে গল্প পড়তাম অনেক, সবাই কমবেশি তেমনই পড়ে। আমরাও এখন ছোটদের পড়াই, আমাদের বড়রাও পড়েছেন। রূপকথা পড়তে পড়তে রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্য-দানো, হিজিবিজি সব গল্প পড়েছি। পড়েছি বিদেশের অনেক গল্প, মালয়-চীনের রুপকথা। কোথাও বেড়াতে গেলে বুকশেলফ, টেবিলের পাদানির নিচে ঘেঁটে-ঘুটে বই খুঁজে পড়ে সময় কাটাতাম। কিছু বই পড়ে কল্পনাশক্তি বাড়তো, আনন্দ হতো। কিছু বই পড়ে গা ঘিনঘিন লাগতো কেননা গল্পের দৃশ্যপট খুব বাজে ও নোংরা মতে হতো। স্মৃতিগুলো আমি ভুলিনি, মনে দাগ কেটে আছে সেসব সময়গুলো…
এখন বাচ্চাদের বই কিনতে দোকানে গেলে প্রায়ই মাথা চুলকে ফিরে আসতে হয় আমার। বই কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা। কেনা সেই বই থেকে একটা বাচ্চাকে গল্প বলা হবে, সে সেই বিষয়গুলো কল্পনা করবে, সেখানে সে শিখবে, সে নিজেও সেই জিনিস বলবে… এই চক্রটার শুরুটায় সুন্দর কিছু থাকা উচিত তা আমি বুঝি। এমন সব বিষয়ে আমি ঠাকুমার ঝুলি আর ঠাকুরদার ঝুলি মার্কা গল্পের কথা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। ভুত-প্রেতের গল্পগুলোর কথা নাইবা বললাম। আমি একবার পড়েছিলাম, যে সন্তানদেরকে ভুতের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ান মায়েরা, তাদেরকে কীভাবে শত্রুর সামনে সত্য কথা বলতে এবং অন্যায়ের প্রতিরোধে জিহাদে পাঠাতে পারবেন তারা?
নিঃসন্দেহে বাচ্চাদের কী পড়ানো হবে তাদের আত্মিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য, সে বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তা গবেষণার এবং পড়াশোনার দাবী রাখে। একবার শাইখ হামজা ইউসুফের আলোচনায় [১] শিখেছিলাম যে প্রতিটি সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য, তার মানসিক উৎকর্ষতার জন্য প্রয়োজন গল্প। প্রতিটি মানব মনে আছে গল্প শোনার একটি তৃষ্ণা যা কেবল কুরআনের গল্পগুলোই মেটাতে পারে। বিভিন্ন গল্প হয়ত আমাদের মনে আনন্দ দিতে পারে, ভালোলাগা তৈরি করতে পারে কিন্তু হৃদয় জুড়িয়ে যাওয়ার গল্প কেবল সেগুলোই যা কুরআনে উল্লেখিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সুরা ইউসুফে [২] বলেছেন, তিনি কুরআনে ‘আহসানাল ক্বাসাস’ বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ সমস্ত গল্পের মধ্যে উত্তম গল্প আল্লাহ উদ্ধৃত করেছেন আল-কুরআনুল কারীমে। এটা নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, শ্রেষ্ঠ গল্প আসলে সেগুলোই যা কুরআনে উদ্ধৃত, যা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানিয়েছিলেন ওয়াহির মাধ্যমে যা আর কেউ এভাবে জানতো না।
সূরা ইউসুফের সেই আয়াতটি আমাকে কুরআনের গল্পগুলোর মহত্বের ব্যাপারে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। ইমাম আওলাকীর নবীদের জীবনীর উপরে লেকচার [৩] শোনার সময় শিখেছিলাম, কুরআনের গল্পগুলো আল্লাহ আমাদেরকে এমনি এমনি জানাননি মোটেই। বরং কুরআনের গল্পগুলো, উল্লেখিত ঘটনাগুলো আমাদের জানা উচিত এই কারণে যে তা আমাদের জীবনের প্রতিটি সময়েই কাজে লাগবে। সত্যিই নিজ জীবনের অনেক সময়ে ইউসুফ আলাইহিস সালাম, ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা আমার প্রেরণা হয়ে ছিলো। সবরের শিক্ষা, আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের শিক্ষা, আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা, ইস্তিগফারের শিক্ষা পাই আমরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জীবন থেকে। কুরআনের গল্প, আম্বিয়াদের গল্প, রাসূলুল্লাহর জীবনী, সাহাবাদের জীবনী জানার উপকার এমনই যে তা আমাদের জীবনের পরিস্থিতিগুলোতে শিক্ষা ও প্রেরণা হিসেবে রবে। কী করতে হবে, কী করা উচিত সেসব চিন্তার খোরাক এবং বুকে হিম্মত যোগাতে সাহায্য করবে আমাদের সেইসব গল্প।
শাইখ ইয়াসির ক্বাদীর কাছে সুন্দর বর্ণনা শিখেছিলাম [৪] ‘আহসানাল ক্বাসাস’ নিয়ে। ‘ক্কিসাহ’ কী? এই ‘ক্বিসাহ’ শব্দটি এসেছে ‘ক্বাসাহ’ থেকে যার অর্থ হলো বালুর উপরে থাকা পদচিহ্ন। যখন বেদুইনরা কোন পায়ের চিহ্ন খুঁজে পেতো, তারা সেই পায়ের ছাপ অনুসরণ করে সেই মানুষটিকে ধরতো। একটি গল্প কেমন করে পায়ের ছাপের সাথে সম্পর্কিত হয়? যখন আপনি গল্প শোনেন, আপনি সেই মানুষগুলোর চলে যাওয়া পথে সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন এবং তাদের অনুসরণ করতে থাকেন। আপনি যখন গল্প বলেন তখন আপনি সেই জীবনটিকে নিজের অন্তরে ধারণ করেন এবং বলেন। সূরা কাহফের বর্ণনায় আছে মুসা (আলাইহিস সালাম) তার সঙ্গীকে নিয়ে পেছনের পথে যেখানে মাছটি যেখানে সমুদ্রে মিশে গিয়েছিলো সেখানে যেতে রওনা হলেন– সেই বর্ণনায় যে শব্দটি এসেছে তা হলো ‘ক্বাসাসা’। সেই আয়াতটির [৫] বাংলা অনুবাদ– “সুতরাং তাঁরা নিজেদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ফিরে চললেন।”
গল্পের আরেকটি উপকার হলো এতে বিশ্বাসকে কর্মে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। মুখে তো আল্লাহর উপরে ভরসা করার কথা বলা হয় অনেক, কিন্তু যখন আমরা দেখতে পাই ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আগুণে ছুঁড়ে দেয়া হলো তবু তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে আছেন তখন সেই বিশ্বাসকে কর্মে রূপান্তরিত দেখতে পাই। ইমাম সুহাইবের [৬] আলোচনায় জেনেছি, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় বড় আলেমরা এমন হালাকাতে অংশগ্রহণ করেন যাতে সলিহীনদের জীবনী আলোচনা করা হয়, তারা কেবল শক্ত শক্ত তত্ত্বকথা, শারীয়’আহর মাকাসিদ এবং ফিকহ নিয়ে আলাপ করেন না। তিনি কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, পূর্ববর্তী আম্বিয়াদের জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে এমন শিক্ষা যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই দিকনির্দেশনা দান করে। ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে পূর্ববর্তী সলিহীনদের (সৎকর্মশীলদের) হিকায়াত নাকি ফিকহের চেয়েও প্রিয় ছিলো। সৎকর্মশীলদের জীবনীতে জানা যায় কীভাবে তারা আল্লাহর দেয়া নির্দেশ পালনে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ করেছিলেন।
কুরআনের গল্পগুলো কেন ‘সেরা গল্প’ তার বেশ কিছু কারণ আছে–
১) কুরআনে আমরা যা শিখি তা সবই সত্য, বানোয়াট কোন কাহিনী নয়। একটি সত্য ঘটনা সবসময়েই কাল্পনিক ঘটনার চেয়ে শক্তিশালী হয়।
২) কুরআনের গল্পগুলোতে রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা।
৩) কুরআনের গল্পগুলো অনুপম ভাষাশৈলী ও উপস্থাপনায় উল্লেখ হয়েছে, কুরআনের গল্পের চেয়ে সুন্দরভাবে কোন গল্প লেখা হতে পারে না।
৪) মানুষ যেসব গল্প লিখে তাতে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত তথ্য দেয়া হয়ে যায় যা আদর্শিক শিক্ষা থেকে বিচ্যূত করে। আল্লাহ আমাদের ঠিক ততটুকুই তথ্য দিয়েছেন যা বেশিও নয়, কমও নয়।
যেকোন বয়সেই মানুষ গল্প ভালোবাসে। গল্প মানুষকে আনন্দ দেয়। গল্প থেকে শেখার থাকে, বোঝার থাকে। তবে ছোটবেলার শিক্ষা ও প্রেরণা বড় হবার পথে ভিত্তি হিসেবে, শেকড় হিসেবে ভেতরে প্রোথিত হয়ে যায়। সন্তানকে বড় করার পথে তাই ঠাকুমার ঝুলি, গোপাল ভাঁড়, ভুত-পেত্নী-দৈত্য-দানোর গল্প পড়তে দিয়ে কোমল মনগুলোকে তিক্ত করার আগেই কুরআনের গল্পগুলো, হাদিসের গল্পগুলো, সালাফদের জীবনীগুলো আমাদের সন্তানদের শেখানো উচিত। নৈতিক, ঈমানী, আদর্শিক শিক্ষা আমরা এভাবেই সন্তানদের মাঝে, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারি। শুধু সন্তানদের কথাই নয়, যারা শিশু থেকে ‘বুড়ো’ হয়ে গেছি এবং এতদিনে এসে সেগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছি, তাদের উচিত এখনই গভীরভাবে কুরআন ও কুরআনের গল্পগুলো অধ্যয়ন করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আখিরাতের উন্নত জীবনের আশায় দুনিয়াতে প্রস্তুতি নেয়া।
ইমাম ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) ‘তার ক্বাসাসুল কুরআন’ বইটিতে ১৯টি গল্পের কথা উদ্ধৃত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে হাবিল-কাবিলের গল্প, হারুত ও মারুত, মুসা (আ) ও খিজির, কারুন, উজাইর, যুলকারনাইন, ইয়াজুজ-মাজুজ, আসহাবে কাহফের গল্প, লুকমানের গল্প, আসহাবুল উখদুদ, হাতিওয়ালা আবরাহার গল্প। ইমাম ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘ক্বাসাসুন নাবিয়্যি’ গ্রন্থে ২৫ জন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের বর্ণনা করেছেন, যার প্রতিটি আমাদের কাছে সত্য এক ইতিহাস, অনুপ্রেরণা, শিক্ষা। তারা প্রত্যেকেই আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক। জান্নাতে স্থান যদি আল্লাহ দয়া করে দেন, তাহলে এই মানুষগুলোর সাথে দেখা হবে একদিন আমাদের ইনশাআল্লাহ –এমন অনুভূতি আমার মনকে উচাটন করে।
আমাদের সন্তানদের জন্য, তাদের উত্তম মানস গড়ে তোলার জন্য তাই ‘আহসানাল ক্বাসাস’ বা উত্তম গল্পগুলোই বেশি বেশি শোনানো উচিত। সাহাবাদের জীবনে আমরা পাবো কেমন করে তারা শ্রেষ্ঠ মানুষ রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ করেছিলেন। তাছাড়া, আদর্শ হিসেবে তো আল্লাহ সেই মানুষটিকেই পাঠিয়েছেন যাকে তিনি ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন কুরআনুল কারীমে। আল্লাহ আমাদেরকে সেরা গ্রন্থের সেরা মানুষদের আলোকে এবং শ্রেষ্ঠতম মানুষটির আদর্শে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে উপকারী জ্ঞান দান করুন, আমাদের জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে দিন, হৃদয়কে প্রশস্ত করে দিন।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
[১] ভিডিও: Intellectual Structure of Islamic Civilization: https://www.youtube.com/watch?v=oxMfx3LUlPE
[২] সূরা ইউসুফের ৩নং আয়াতের বঙ্গানুবাদ: http://tanzil.net/#trans/bn.bengali/12:1
[৩] লাইফ অফ দা প্রোফেটস : http://www.kalamullah.com/anwar-alawlaki.html
[৪] সেরা গল্প : http://muslimmatters.org/2011/04/22/the-best-of-stories-pearls-from-surah-yusuf-part-1/
[৫] সূরা কাহফের ৬৩ নং আয়াত: http://tanzil.net/#trans/bn.hoque/18:64
[৬] ইমাম সুহাইব ওয়েব: https://www.youtube.com/watch?v=74NIG1tzZFk
* * * * * * * * * *
গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক (ইংরেজিতে):
# শিশুদের জন্য বই [কালামুল্লাহ ডট কম] : http://www.kalamullah.com/children.html
# ইবনে কাসীর [কাসাসুল কুরআন] : https://www.kalamullah.com/Books/StoriesQuran.pdf
# জামান পরিবারের রচনা: http://www.themessagecanada.com/english/about/for-children-english
# শিশুদের কালারিং বুক: http://www.themessagecanada.com/english/about/islamic-coloring-book
* * * * * * * * *
গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক (বাংলায়):
# শিশুদেরকে গল্প বলার নানা বিষয় ও কৌশল: https://learningfrommylife.wordpress.com/telling-stories-to-kids/
# অনেকগুলি বই PDF ফরমেটে ফ্রি পাবেন এই লিংকে: http://www.themessagecanada.com/english/about/for-children-bangla
* * * * * * *
১৭ মুহাররাম, ১৪৩৬ হিজরি।
১১ নভেম্বর, ২০১৪ ঈসায়ী।