সম্ভবত ক্লাস এইটের একটা ঘটনা। ক্লাসটীচার পড়াতেন ইংরেজি, ধর্মীয় জ্ঞানও খারাপ না। একদিন আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের ধর্ম বইয়ের নাম কী। কেউই ঠিক মতো বলতে পারলাম না। বই বের করে দেখা গেলো ‘ইসলাম শিক্ষা’। এক হিন্দু ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন তাদের বইয়ের নাম কী। সে দেখালো ‘হিন্দু ধর্ম শিক্ষা’। বাকি দুটা ‘খ্রিষ্টান ধর্ম শিক্ষা’ ও ‘বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা’। স্যার শুধু মাথা নাড়লেন, এ ব্যাপারে আর কখনোই কিছু বললেন না। তবে সবাইই খেয়াল করলো ‘ইসলামে’র সাথে ‘ধর্ম’ কথাটা নেই!
বিশেষ এক শ্রেণীর চাপে পড়ে বর্তমানে NCTB প্রণীত ধর্ম বইগুলোর নাম হয়ে গেছে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’, ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’, ‘খ্রিষ্টান ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’, ‘বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’। কেন করা হয়েছে তা খুব স্পষ্ট। নাস্তিকতা এখনো আমাদের সমাজে স্বীকৃত নয়। অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের পরও ‘নাস্তিক’ একটা গালি। মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য পরিবারের নাস্তিক সন্তানেরা বাধ্য হয়ে ধর্ম বই পড়ে। তাদের কাছে সাবজেক্টটাকে আপন বানানোর জন্যই চারটা বইয়ের নামের ফাঁকে ‘ও নৈতিক’ যোগ করা।
যাই হোক, এখানেও ‘ইসলামে’র সাথে ‘ধর্ম’ কথাটা নেই। অন্য তিনটির ক্ষেত্রে আছে। এমনকি ‘ধর্ম’ লিখে বাংলা উইকিপিডিয়া সার্চ করলাম। সেখানেও খ্রিষ্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বাহাই ধর্ম, শিখ ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, জৈন ধর্ম, তাও ধর্ম, কনফুসিয়াস ধর্মের সাথে একই লিস্টে আছে ‘ইসলাম’। আগে পরে ধর্ম-অধর্ম কিছু নেই!
‘ধর্ম’ কথাটার অর্থ খুঁজতে গেলে অনেক বিপত্তি হয়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ দেখতে গিয়ে কয়েকরকম অর্থ পেলাম। একদম সরলীকৃত অর্থ হলো কোনোকিছুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য (practice, property, attribute, nature, disposition)। যেমন পানির ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, আগুনের ধর্ম প্রজ্জ্বলিত হওয়া ও পোড়ানো। ধর্মের আরেকটা অর্থ হচ্ছে দায়িত্ব (duty, law)। অথবা নৈতিকতা (virtue, morality, justice)। সংস্কৃত ভাষায় dharma বলতে এরকম নৈতিকতা, দায়িত্ব ইত্যাদিই বোঝাতো। ধর্মের আরেকটা অর্থ হলো প্রচলিতভাবে আমরা যা বুঝি—Religion.
সহজভাবে দেখলে এই রিলিজিয়ন বা ধর্মগুলো কিন্তু কিছু নীতি নৈতিকতারই সমষ্টি। তবে দার্শনিক তত্ত্বগুলোর সাথে পার্থক্য হলো ধর্মে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রতি আনুগত্য, আশা ও ভয়ের ব্যাপার থাকে। নাস্তিকরা এই নৈতিকতার কনসেপ্টটা স্বীকার করে, অতিপ্রাকৃতের বিষয়টা প্রত্যাখ্যান করে।
ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মগুলোর পার্থক্যটা ভালো করে বুঝতে এদের ইংরেজি প্রতিশব্দগুলো দেখুন। সবগুলোর শেষে -ism বা -ity suffix যুক্ত আছে (Hindu-ism, Christian-ity, Juda-ism, Buddh-ism)। আবার প্রতিটি ধর্মই স্থান বা ব্যক্তিবিশেষে নির্দিষ্ট (Hind, Christ, Buddha, Judas)। শেষে -ism থাকা বা ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত হওয়াটা দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদগুলোর বৈশিষ্ট্য। এই -ism এর বাংলা করলে হয় ‘-বাদ’, ‘-তন্ত্র’ ইত্যাদি। যেমন নাস্তিক্যবাদ (Athe-ism), সমাজতন্ত্র (Social-ism), মার্ক্সবাদ (Marx-ism) ইত্যাদি। Religion এর ক্ষেত্রে বাংলায় -ism এর প্রতিস্থাপক হচ্ছে ‘ধর্ম’ কথাটা। মানবরচিত মতবাদগুলোর সাথে এসকল ধর্মের এমন অদ্ভুত মিল দেখে কিছু আঁচ করতে পারছেন কি?
ইসলাম ছাড়া কোনো ধর্মের ধর্মগ্রন্থে সেই ধর্মের নাম নেই। অনুসারীদের কী নামে ডাকা হবে তা-ও নেই। তাই এগুলো পরে উদ্ভাবন করতে হয়েছে। ঐশ্বরিক পরশে যেরকম সর্বজনীন ও সুগঠিত হওয়ার কথা ছিল, এসব ধর্মে তা নেই।
ইসলাম সেখানে আপন বৈশিষ্ট্যে আলাদা। পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে নিজের টার্মগুলোকে ইসলাম এত সুগঠিত রেখেছে যে অন্য ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে suffix যোগ করাটা একটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। Suffix যোগ করা গেলে ইসলামকেও অন্যান্য Religion এর মতো অ-সর্বজনীন একটা মতবাদ হিসেবে দেখানো যেতো। কথায় কথায় ‘ইসলাম ধর্ম’ বলা হলেও অফিসিয়াল বা ফর্মাল জায়গায় শুদ্ধতর করে তাই শুধু ‘ইসলাম’ লিখতে হচ্ছে।
ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাগুলো বলে দেয় কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আর কীভাবে সেই ঠিক পথে পৌঁছানো যায়, কীভাবে ভুলটা এড়ানো যায় এসব ঠিক করে দেয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদগুলো। অন্যান্য ধর্মগুলো নীতিকথা কপচানোর পর রাজনীতির মাঠে কিছু বলতে পারে না। তাই গণ-তন্ত্র, সমাজ-তন্ত্র কিছু একটাকে বেছে নেয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও পুঁজি-বাদ, সমাজ-বাদ কিছু একটা মেনে নেয়। সেখানে ইসলাম যখন নিজস্ব অর্থনীতি, বিচারনীতি, সমরনীতি নিয়ে সেক্যুলার মতবাদগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়, মানুষ অবাক হয়ে যায়। ‘Islam-ism’, ‘Islam-ist’ এসব শব্দ ব্যবহার করে মূলধারার ইসলাম থেকে আলাদা করতে চায়। অথচ কাউকে নামাজ-রোজা করতে দেখলে কিন্তু ঠিকই ‘Muslim’ বলে, ‘Islamist’ বলে না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের সাথে এক কাতারে বসানোটাই ভুল। তার উপরে নাস্তিকদেরকে খুশি করতে সব ধর্ম বইয়ের শেষে ‘ও নৈতিক শিক্ষা’ কথাটা যোগ করে একে আরো নিচে নামানো হচ্ছে। এভাবে ‘নৈতিক শিক্ষা’ কথাটা যোগ করা কেবল শুরু। আস্তে আস্তে শুধু ‘নৈতিক শিক্ষা’ শিরোনামে সব ধর্মের পাঠ্যপুস্তককে একীভূত করা হবে। দেখানো হবে যে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগুলো কেবল কিছু Moral philosophical মতবাদ। মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত concept, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সমাজে শৃঙ্খলা আনয়ন। অতিপ্রাকৃতিক শক্তিধর কোনো আল্লাহর অস্তিত্ব নেই (না’উযুবিল্লাহ)।
এভাবে চললে প্রথম যেই ধাক্কাটা আসবে সেটা হলো মানুষ জীবনের মানে হারিয়ে ফেলবে। ইউরোপে এমনটা হয়েছিলো। বিজ্ঞানকে ঢাল বানিয়ে চালানো নাস্তিকদের প্রোপাগাণ্ডার বিপরীতে মানবরচিত খ্রিষ্টানধর্ম টিকে থাকতে পারেনি। হঠাত্ করেই মানুষ আবিষ্কার করলো ঈশ্বর বলে কেউ নেই! এখন কী হবে? সবাই খেই হারিয়ে জাগতিক উন্নতির পেছনে ছুটতে লাগলো। উদ্দেশ্যহীন এক জীবনে টাকাই হয়ে উঠলো ঈশ্বর। বিষয়টা খুব ভাল করে ভেসে উঠেছে Victorian যুগের (মোটামুটি ১৯শতক) সাহিত্যগুলোতে। ম্যাথু আর্নল্ড এই আচমকা পরিবর্তনকে বলেছেন ‘আধুনিক জীবনের অদ্ভুত ব্যাধি’ (strange disease of modern life).
পরবর্তী নাস্তিকেরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তারা দেখেছে মিথ্যা ধর্মগুলো যেই নৈতিক মানদণ্ড সরবরাহ করতো, তাদের মতাদর্শে সেটাও নেই। লোহা দিয়ে বিমান তৈরি করে লোহার উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মানুষগুলোর উন্নতি হচ্ছে না। তাই নীতি নৈতিকতার ফীল্ডে তারা নিজস্ব মতবাদ খাড়া করলো। ঠেস দিয়ে, গোঁজামিল দিয়ে তৈরি এই ধর্মের নাম দিলো ‘মানবধর্ম’। একসময় মানুষগুলোকে বাঁদরের চেয়ে অধম বানানো লোকগুলো আজকে ভাব ধরছে যেন সমগ্র মানবজাতিকে নাজাত দিতে এসেছে তারা। ইতিহাসের দেওয়া সাক্ষ্যকে তারা আড়াল করছে ‘মানবধর্মে’র ব্যানার দিয়ে।
মানবধর্মে ‘ধর্ম’ কথাটা কোন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে? যদি ‘স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে
- মানুষ খাদ্য খায়, গুবরে পোকাও খাদ্য খায়। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
- মানুষ পানি পান করে, বাইম মাছও পানি পান করে। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
- মানুষ ঘুমায়, শালিক পাখিও ঘুমায়। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
- মানুষ মলত্যাগ করে, ভোঁদরও মলত্যাগ করে। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
সবচেয়ে বড় কথা, Religion এর মোকাবেলায় এসব ধর্মের কথা এনে লাভটা কী?
মানবধর্মের ‘ধর্ম’ কথাটা যদি কর্তব্য/নৈতিকতা অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে
- মানুষ পরোপকার করে, মানুষ অন্যের ক্ষতি করে। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
- মানুষ দান করে, মানুষ চুরি ডাকাতি করে। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
- মানুষ বিয়ে/প্রেম করে, মানুষ ধর্ষণ করে। এখানে মানবধর্ম কোনটা?
কোনটা নৈতিক, কোনটা অনৈতিক এটা ঠিক করার কর্তৃপক্ষ কে? সকল দেশে, সকল আইনে ধর্ষণের শাস্তি, এমনকি ধর্ষণের সংজ্ঞাতেও এত পার্থক্য কেন? যেই ‘মানবধর্ম’ টার্মের চাদরে সব ধর্মের লোকদেরকে একটা কমন নৈতিক মানদণ্ড দিতে চাওয়া হয়েছিলো, তা কতটা সফল? কতটা বাস্তবসম্মত?
‘মানবধর্মে’র প্রচারকরা কখনোই পারবে না ঈশ্বরের ধারণা আমদানি করে প্রচলিত Religion গুলোর মতো হতে। তাই ইসলাম ও অন্যান্য Religion গুলোকে নিজের কাতারে নামিয়ে এনে দেখাতে চাইছে “আমরাই সবচেয়ে কম ত্রুটিযুক্ত!” (যেহেতু শতভাগ ত্রুটিহীন হওয়া তাদের মতে অসম্ভব)।
কিন্তু আমরা পূর্বের আলোচনায় দেখেছি অন্যান্য ধর্ম, মতবাদ, পন্থাগুলো ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ারই অনুপযোগী। মানবধর্ম তো সেসবেরও অধম। এই সকল ধর্মের উপাস্য হলো শাইত্বান। আর শাইত্বানের চক্রান্ত অত্যন্ত দুর্বল।
NCTB’র সেই উদ্যোগটার ব্যাপারে তাই সাবধান হওয়া উচিত। স্পষ্ট হকের উপরে থেকেও কেবলমাত্র ‘সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো’র ব্যানারে কেন আপনি হককে বিসর্জন দেবেন? এসকল বাতিল মতবাদ তো আপনার সঠিক মতবাদকেই সম্মান দিতে জানে না!