সুফিয়ান এর দোকানে বসে আছি। এই দোকানকে টং এর দোকান বললে অসম্মান হবে, তবে মুদি দোকানও বলা যাবেনা, এর মাঝামাঝি কোন নাম দিতে হবে। সুফিয়ান দিয়েছে, ‘সাল্লাহউদ্দিন এর বাবার দোকান।’ নাম পপুলার হয়নি, কেউ সালাহউদ্দিন এর বাবার দোকান বলেনা, বলে সুফিয়ানের দোকান। দোকানের ওপর যেই টিন দেয়া তাতে ৫ টা ফুটো, এই তথ্য সুফিয়ানের দেয়া। বৃষ্টি আসলে ফুটো দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে, আমার ধারণা ফুটোর সংখ্যা ৫ এর অধিক। আমরা অত্যধিক সকালে চলে এসেছি। চা’য়ের পানি এখনও গরম হয়নি। সুফিয়ানের দোকানে তিন ধরনের চা পাওয়া যায়। কমলা লেবুর চা, খাটি দুধের চা এবং লাশের চা। মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতিদিন অনেক লাশ জমা হয়, এই লাশ গুলোর সাথে র‍্যাবের একটা সংযোগ আছে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামক একটা যুদ্ধে এরা মারা যায়। লাশের পাশে পড়ে থাকে ছয় রাউন্ডের একটি পিস্তল আর কিছু হাত বোমা। এসব লাশ মর্গে পড়ে থাকে অনেক দিন। লাশ সংরক্ষণের সস্তা পদ্ধতি চা পাতা। ব্যবহারের পর এসব চা পাতা বস্তা ভরা হয়। রাতের অন্ধকারে টং এর দোকানিরা অত্যন্ত সস্তায় এসব পাতা কিনে আনে। লাশের চায়ের গল্পটা করেছেন ওসি ফারুক, আমাকে নয় আমার বাবাকে। বাবা তো তাজ্জব হলেন! কি হচ্ছে এই দেশে! ফারুক সাহেবও একমত হলেন। দেশের কি হচ্ছে এই নিয়ে তারা চিন্তিত। বাবা পরদিন আমাকে ডেকে টং এর দোকান থেকে চা খেতে নিষেধ করলেন। সুফিয়ান এর দোকান টং নয় বলে চা খাওয়া যায়। তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস সুফিয়ানের দোকানের চা’ও লাশের। সুফিয়ানকে কি জিজ্ঞেস করব?

ভাইয়া মোবাইলে অপরপ্রান্তকে জানাচ্ছেন, উনি ‘সালাহউদ্দিন এর বাবার দোকানে’ চা খেতে এসেছেন। সুফিয়ান এর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। ভাইয়া তার দোকানের সঠিক নাম দিয়েছেন। এই ফাঁকে লাশের বিষয়টা জিজ্ঞেস করা যায়।

- সুফিয়ান ভাই!
- হুম। আইজকা মনে অয় বৃষ্টি অইব! কি কন?
- মনে হয়। তুমি কি মর্গে যাও? মানে হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল এর দিকে?
- কেন ভাইজান? মাঝে মধ্যে যাই।
- না! এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।

পানি গরম হয়েছে। আমাদের জন্য আজ বিশেষ চায়ের ব্যবস্থা হচ্ছে।

- ভাই! আপনার দোকানের সাইনবোর্ডে ভুল আছে। ‘সালাহউদ্দিন’ এ একটা ‘ল’, আপনার সাইনবোর্ড এ দু’টা। সালাহউদ্দিন কি আপনার ছেলের নাম?
- হ’অ। আমার একডা মাত্র পোলা। গরীবের চোখের মনি। দো’আ করবেন ভাই! আমনে হুজুর মানুষ, দোয়া’য় কাজ হইবো।

ভাইয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করলেন। ‘হে আল্লাহ, তুমি এই ছেলেকে সালাহ আদ- দ্বীন হিসেবে গড়ে তোল। জেরুজালেম এর সালাহ-আদ দ্বীন।’

- ভাইজান! কিসের জানি নাম নিলেন?
- জেরুজালেম। আল আকসার নাম শুনেছেন? ফিলিস্তিন?
- হুনছি। তয়, আমগো সালাউদ্দিন ঐখানে কি করব?
- ঐখানে কিছু করবেনা। সালাহ আদ-দ্বীন হচ্ছে জেরুজালেম বিজেতা, আল আকসা বিজেতা। খ্রিস্টানদের থেকে আল আকসা উদ্ধার করে সালাহ আদ-দ্বীন। বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন, তাকওয়াবান মানুষ ছিলেন। জেরুজালেম এখন আর আমাদের নেই, খ্রিস্টান ইহুদীদের দখলে। আরেকজন সালাহ আদ-দ্বীন দরকার।

সুফিয়ান এর চোখ পানিতে ছলছল করছে, মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। পুরুষরা সহজে কাঁদেনা, চোখের পানির ওপর তাদের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আছে। তারা যোদ্ধা, যোদ্ধাদের কান্না মানায়না।


সুফিয়ানকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিসে চাকরি দেয়া উচিত। তার ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল ১০ টা থেকে, থামার কোন নাম গন্ধ নেই। ওসি ফারুক ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। ওসি ফারুক এসেছেন চা খেতে। তাকে চা দেয়া হয়েছে। বাবা বাসায় নেই বলে ‘দেশের কি হচ্ছে’ বিষয়ক আলোচনা শুরু করা যাচ্ছেনা। আলোচনা’র জন্য দু’জন দরকার হয়। আমি কি ২য় জনের চরিত্র নিব?

ভাইয়া এসে বসেছেন। আমি কথা শুরুর জন্য অপেক্ষমান।

- আংকেল, জালাল হুজুর কি ছাড়া পেয়েছেন?
- আমি তো ঠিক বলতে পারবোনা বাবা। কয়েকদিন ঐদিকে যাওয়া হয়না।
- ডিবি তে না আপনার এক ভাই আছে। তার থেকে কি খোঁজ নেয়া যায়?
- নেয়া যায়, কেন বাবা? তুমি কি তাকে ভালোভাবে চেন?
- হুম। উনি ভার্সিটির জিয়া হলে নামাজ পড়াতেন। আমি কিছুদিন জিয়া হলে ছিলাম, সেই থেকে পরিচিত। বেচারা বৃদ্ধ মানুষ, দু’টো মেয়ে আছে। মেয়েদের এখনো বিয়ে দেননি। আর এখন পড়লেন এই ঝামেলায়।
- ঝামেলায় জড়িয়েছেন কেন?
- ঝামেলায় ইচ্ছে করে জড়াননি। আপনি কি তার ঘটনা জানেন?
- না। কানে এসেছে, উনি নাকি জামাত করেন।
- জুমার খুতবা নিয়ে সমস্যা। খুতবায় বলেছেন, ‘আল্লাহ তুমি এই দেশকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা কর।’ সেই রাতেই উনাকে সরকারি দলের লোকজন পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে, মোট এক ডজন মামলা দেয়া হয়েছে গাড়ি ভাঙ্গচুর হতে জঙ্গিবাদ, গ্রেনেড। বেচারা গরিব মানুষ। কিছু কি করা যায়?
- চেষ্টা করে দেখব।
- ধন্যবাদ, আংকেল।

বেচারার কথা শুনে আমার খুব মায়া লাগছিল।

রাতে বাবা এসে আমাকে ডেকে বললেন, তোর ভাই কোথায় যায়, কার সাথে মিশে খেয়াল রাখিস তো। ওসি ফারুক বিকালে কল দিয়েছে।

ওসি ফারুক ভাইয়া বিষয়ে বাবাকে একটা লাইনের বেশি বলতে পারেননা—‘খেয়াল রাখবেন ভাই, জঙ্গিদের টার্গেট ট্যালেন্ট ছেলেপুলে।’

বাড়িওয়ালা এক সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছেন। বাবাকে জানিয়ে গেলেন, আমরা ইচ্ছা করলে বাড়িতে থাকতে পারি। উনি চান, আমরা বাড়িতে থাকি। আগের ঘটনার জন্য উনি লজ্জিত। অন্য ভাড়াটিয়াদের চাপে লজ্জাজনক কাজ করেছেন। ঢাকার বাড়িওয়ালারা ভাড়িটিয়াদের কাছে লজ্জিত হননা, তারা ভাড়াটিয়াদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবে। আমাদের বাড়ির মালিকের আচরণে তাই মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এইবার আর ভাইয়ার ঢাবির শিক্ষক হওয়া হলোনা। চেয়ারম্যান ঝামেলা করেছেন। উনি ডিপার্টমেন্টে জঙ্গি নিতে চাননা। ভাইয়ার ভাইভা তুলে ধরা হলো, বোর্ডে ছিলেন চেয়ারম্যান সহ মোট চারজন।

চেয়ারম্যানঃ (ভ্রু কুঁচকে) তুমি কি আইএস কর?
ভাইয়াঃ জি না স্যার।
চেয়ারম্যানঃ (ভ্রু কুঁচকানো অব্যহত রয়েছে) তাহলে কি শিবির?
ভাইয়াঃ না।
২য় জনঃ তুমি কি জাতীয় সঙ্গীত গাও?
ভাইয়াঃ স্কুলে থাকতে পিটিতে গাইতাম, কলেজ ভার্সিটিতে তো পিটি নেই তাই গাইতে হয়না।
চেয়ারম্যানঃ জাতীয় সংগীতের কয়েকটা লাইন গাও দেখি?
ভাইয়াঃ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায়…।‘
৩য় জনঃ তাবলীগে যাও?
চেয়ারম্যানঃ তাবলীগ জামাত?
ভাইয়াঃ না। কখনো যাওয়া হয়নি।
বোর্ডের একজন অন্য জন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, মানে, বলেছিলাম না।
৪র্থ জনঃ Portfolio Theory কে আবিষ্কার করেছেন?
ভাইয়াঃ Markowitz.
চেয়ারম্যানঃ ক্লাসে দাঁড়িয়ে কোন ছাত্র তোমাকে বলল, আমি জঙ্গি’র ক্লাস করবোনা। তুমি তখন কি করবে?
ভাইয়াঃ বলবো, ‘জঙ্গি তো ক্লাস নেয়না, ক্লাসে যিনি লেকচার দেয় তিনি লেকচারার, যুদ্ধে যে অংশ নেয় সে জঙ্গি। যেমনঃ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। আমার পক্ষে যুদ্ধের মতো কঠিন জিনিসে যাওয়া সম্ভব নয় বলে আমি হয়েছি লেকচারার। তোমাকে জঙ্গির ক্লাস করতে কে বলেছে?’
চেয়ারম্যানঃ জঙ্গি মানে যোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধা! (অনেকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে, কিন্তু চেষ্টা করছেন উত্তেজিত না হতে। দাঁত একটার সাথে আরেকটাকে চেপে ধরেছেন। পেপসোডেন্ট দিয়ে দাঁত মাজেন বলে, সবগুলো এখনো স্ব-স্থানে আছে।)
ভাইয়াঃ জি স্যার! তবে ‘মুক্তি’ শব্দের জন্য আরেকটা বিশেষণ জঙ্গির সামনে বসবে, বিশেষণটা আমার জানা নেই, স্যার।

ভাইয়া রাতে এসে আমাকে আর মাকে ভাইভার গল্প শুনিয়েছেন। আমাদের বলে ভাইয়া মজা পাচ্ছিলেন, লেকচারার হতে হবেনা এইটা আনন্দের বিষয় আমার জানা ছিলনা। রেজাল্টে দেখা গেলো, ভাইয়ার এক মেয়ে ক্লাসমেট লেকচারার হয়েছেন, কষ্ট করে তাকে ভাইভা বোর্ড পর্যন্ত আসতে হয়নি। ভাইভার দিন উনার এংগেজমেন্ট এর ডেট ছিল, প্লেসঃ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে কল করে জানানো হয়েছে, উনাকে ভাইভা বোর্ড সিলেক্ট করেছে। ভাইয়ার এই নিউজ শুনে বাবার ভীষণ মন খারাপ হলো। উনি এতদিন তার সহকর্মীদের বলে আসছিলেন, বড় ছেলে বেরুলেই ঢাবিতে যোগ দিবে। বাবার জন্য ২য় দুঃসংবাদ হলোঃ বাবা আবার ভূত দেখতে শুরু করেছেন। ভূত পোশাক চেঞ্জ করেছে। সাদা আসকান কালো হয়েছে। রাত দু’টায় কালো জুব্বা পরা ভূত স্টোর রুমে ঢুকে যায়। দিনে স্টোর রুম সার্চ করা হলো, কিছু পাওয়া গেলনা। পাওয়া গেল ভাইয়ার হিসনুল মুসলিম বই।

ইরিনা বার বার কল দিচ্ছে তার ল্যাপটপ দিয়ে আসার জন্য। আজ দিব কাল দিব বলে দেয়া হচ্ছেনা। ইরিনার সাথে কয়েকদিন দেখা হচ্ছেনা, তবে নিয়মিত কথা হচ্ছে। রাত বারোটার পর প্রায় ১ ঘন্টা কথা হয়। ইরিনার সাথে আমার কি কথা হয় তা লিখা যাচ্ছেনা। রাত বারোটার পরের কথা লিখা যায়না। অবশ্য শুরুর কয়েকমিনিট থাকে ইন্ট্রোডাক্টরি টাইপ কথা। গতকালের ইন্ট্রোডাক্টরি কথা লিখা যায়।

- প্রেম টা কি? তা কি তুমি বলতে পারো?
- সঠিকভাবে বলতে পারবোনা।
- প্রেম হচ্ছে অনুভূতি।
- কিসের অনুভূতি?
- কাছে আসার, কাছে পাওয়ার অনুভুতি?
- তাহলে ঐ যে গান আছে, ‘দূরে গেলে যায়রে বোঝা…
- দূরত্ব বাড়লে কাছে আসার আগ্রহ বাড়ে। যত দূর তত আগ্রহ।
- ধর, তুমি এই পৃথিবীতে আর আমি স্যাটার্নে, আমাদের আবেগ কি তখন বাড়বে?
- স্যাটার্ন কি?
- শনি, শনি গ্রহ, চারদিকে বলয়, রিং। ধর, আমি রিং ধরে ঝুলে আছি!
- কিসের রিং ধরে ঝুলে আছ? কি যা তা বলছ!
- আমার ধারণা তখন আমাদের আবেগ থাকবেনা।
- কেন?
- আবেগ হচ্ছে মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো। পৃথিবীর আকর্ষণ ক্ষমতা তো শনি পর্যন্ত পৌছাবেনা।

ইরিনাকে একটা বিষয় বলা হয়নি। ছেলেরা মেয়েদের দেহ দেখে আকর্ষণ বোধ করে, নারী দেহ মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো। আচ্ছা বিয়ের পর কি আকর্ষণ কমে না বাড়ে? দিন যতই যাচ্ছে ইরিনার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়ছে। ভাইয়া বলেছে, মঙ্গলের কোন উপগ্রহ নাকি একসময় মঙ্গলে আছড়ে পড়বে, ইরিনাকে এখন আমার মঙ্গল এর মতো মনে হচ্ছে, আমি আছড়ে পড়ার অপেক্ষায় আছি।

ভাইয়ার সাথে মেয়েলি বিষয় নিয়ে আমার কোন কথা হয়না বললেই চলে। সেদিন হলো, বললাম,

- তুমি বিয়ে করবে না?
- কেন করবোনা?
- না মানে, বিয়ে শাদী তো বৈষয়িক বিষয়। যারা একটু বেশি ধর্ম কর্ম করতে চায়, বিয়ে তো তাদের সমস্যা সৃষ্টি করে।
- হুম। এইরকম একটা কনসেপ্ট আছে। সেই জন্যে খ্রিস্টান, হিন্দু ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা বিয়ে করেনা। আমার একটা হিন্দু ক্লাসমেট আছে। ইসকন এর সদস্য। সে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে, শুনলাম সে নাকি বিয়ে করবেনা।
- আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কি এমন কাউকে বিয়ে করবে যাকে তুমি আগে দেখনি?
- তা তো বলতে পারবোনা। আর আগে না দেখে তো বিয়ে করবোনা। বিয়ের আগে দেখাদেখি সম্পন্ন হবে। মেয়েদের দিকে শুধু একটা সময়েই ভালোভাবে তাকানোর অনুমতি আছে। জানিস?
- না। কোন সময়?
- বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার সময়।
- কোনটা ভালো? আমি একটা মেয়েকে ভালোভাবে চিনি, তাকে বিয়ে করা, নাকি একেবারে অচেনা কাউকে, যাকে এর আগে আমি দেখিনি?
- না দেখে বিয়ে করবি কেন? দেখে শুনেই তো বিয়ে।
- আমি বলতেছিলাম, একটু ভালোভাবে দেখা, অনেকদিন পরিচয়, ভালোভাবে খোঁজ খবর নিলাম, এরপর।
- ভালোভাবে দেখতে কত সময় লাগবে? বছর খানেক? নাকি তার চেয়ে বেশি? আর ভালোভাবে দেখার পদ্ধতিটা কি?

ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। থাকলেও দেয়া যাবেনা। যেই উত্তরে নিজের বিশ্বাস নাই, সেই উত্তর অন্যজনকে দেয়া যায়না। ভাইয়া চুপ করে বসে আছেন। আমি তার যথেষ্ট সময় অপচয় করেছি। উনি এখন বিদায়ী মন্তব্য টানবেন, সেই অপেক্ষা।

বিদায়ী বক্তব্য শুরু হয়েছে, ‘ভালোভাবে দেখার পর, ধর, তোর সিদ্ধান্ত হলো, এটাকে বিয়ে করা যাবেনা। তখন? এই ভাবে একটা মেয়েকে কয়টা ছেলে ‘ভালোভাবে’ দেখবে তা চিন্তা করেছিস? তুই যেটাতে ইয়েস বলবি, দেখা যাবে পূর্বে আরো কয়েকজন ছেলে সেটাকে ‘ভালোভাবে’ দেখে না করেছে।’


‘সালাউদ্দীন এর বাবার দোকানে’ আমরা বসে আছি। আমি আর ভাইয়া। চায়ের পানি গরম হচ্ছে। সালাউদ্দীন এর বাবা ভাইয়াকে কিছু বলবে বলবে এইজন্য অপেক্ষমান। ভাইয়া মোবাইলে কথা বলছেন। কথা শেষের অপেক্ষা।

- ভাইজান, আপনার সাথে কিছু কতা আছিল। ছোট মিয়ার সামনে বলাডা উচিত হইবো কিনা বুঝতাছিনা!
- কি কথা? বলে ফেল সমস্যা নেই। তিন জন কোথাও থাকলে দুজন আলাদা গিয়ে কথা বলা উচিত না। আল্লাহ’র রাসূল (সাঃ) নিষেধ করেছেন।

সালাহউদ্দীন এর বাবা ওরপে সুফিয়ান এর সাথে ভাইয়ার কথোপকথন এর সারমর্ম হলো—সুফিয়ানসহ এই অঞ্চলের আর কিছু লোককে পুলিশ টাকা দেয়, ড্রেস পরা পুলিশ না, সাদা পোশাকের পুলিশ। রাস্তার মোড়ের পা ভাঙ্গা ভিক্ষুকটাও টাকা পায়। এরা এলাকার জঙ্গিবাদ বিষয়ক ইনফরমার। জঙ্গি চিনার কিছু লক্ষণ তাদেরকে বলা হয়েছে। ইয়াং পোলাপাইন হঠাৎ দাঁড়ি রেখে দিবে। হাতে আরবি লিখা বই দেখা যাবে। নিয়মিত নামাজ পড়বে। মোবাইলে কথা বলার সময় লক্ষ্য করতে হবে কিছু আরবি শব্দ উচ্চারণ করে কিনা। বিশেষ কিছু আরবি শব্দ সুফিয়ানদের মুখস্ত করানো হয়েছে একদিন ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে। শব্দ গুলো হলো, জাযাকাল্লাহ, দ্বীন, শরীয়াহ, দায়েশ, জিহাদ, শাম, সালাফ। ভাইয়া সুফিয়ানকে হিসনুল মুসলিম নামক যে বই দিয়েছিল, সুফিয়ান তা পুলিশকে বলেছে, বদৌলতে তাকে টাকার অংকে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে দেখে কপাল খারাপ। সালাউদ্দীন এর ওপর গরম ভাতের মাড় পরে একাকার অবস্থা। জরুরী ভিত্তিতে বার্ন ইউনিটে নিয়ে যেতে হল। সুফিয়ান এর ধারণা এটা তার অপকর্মের ফসল। অপকর্ম থেকে কিছুটা মুক্তি লাভ করতে সে ভাইয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর বাসায় দিয়েছে। ভাইয়াকে কবে কোথায় নেয়া হবে তা সে জানত। পুরস্কারের টাকা’র দ্বিগুন টাকা হসপিটালে দিতে হয়েছে। ভাইয়া যেদিন আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করলেন, সেদিন ডাক্তার বলেছে, আজ ছেলেকে নিয়ে যেতে পারো, মলমটা নিয়মিত লাগাবে আর ঔষুধ দু’সপ্তাহ খাওয়াবে। সুফিয়ান এর ধারণা আল্লাহ ভাইয়ার দো’আ কবুল করেছেন। মানুষের কত রকম চিন্তা। আমার বাবা হলে বলতেন, কোইন্সিডেন্স, জাস্ট কোইন্সিডেন্স। সুফিয়ান ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইল। তার চোখের কোণে পানি। ভাইয়া সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, তোমার ওপর আমার কোন রাগ নেই। অবশ্যই আল্লাহ সব জানেন, তিনি সামি’ঊন আ’লিম।


পাশের বাসা থেকে গন্ধ আসছে। আমি বিছানায় এক পায়ের ওপর আরেক পা রেখে আধ-শোয়া আধ-বসা অবস্থায় পা নাড়াচ্ছি। পাশে Qadar নামক বইটি।

আচ্ছা মন্দ কাজ কি?

সিগারেট খাওয়া কি মন্দ কাজ? আমার বাবা সিগারেট খান। তারা কোন ছেলে সিগারেট খেলে তিনি ব্যথিত হবেন বলে মনে হয়না। তবে তার কোন ছেলে তার সামনে সিগারেট খেলে অবশ্যই তিনি রাগ করবেন, তখন এটা মন্দ কাজ হবে। আমার ভাইয়ার কাছে সিগারেট খাওয়া সবসময় মন্দের, বাবার সামনে খেলেও মন্দের, বন্ধুর সামনে খেলেও। ভাইয়ার মন্দ কাজের ডেফিনেশন সবসময় কোরআন হাদীসে গিয়ে ঠেকে, বাবার ঠেকে সামাজিক রীতিনীতিতে। আমার আজকে মন খারাপ, মানুষ মন খারাপ হলে বিভিন্ন চিন্তা করে, আমার চিন্তা হচ্ছে মন্দ কাজ বিষয়ক। ইরিনার ল্যাপটপে তার ফেসবুক পাসওয়ার্ড সেট করা ছিল। ইনবক্স ঘুরে আমার মনে হল, আমি স্বপ্ন দেখছি, এসব মিথ্যা, এসবও বিশ্বাস করতে হবে! তবে কি ইরিনার সবার জন্যই ME ফোল্ডার থাকে? নষ্ট ল্যাপটপ সবাইকে দেয়া হয়? তবে কি আমাকে টিস্যু পেপার এর মতো ব্যবহার করা হলো! আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা হতে লাগল। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম নাকি প্রচন্ড ব্যথায় ঘুম চলে এলো, বুঝলাম না। উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল, সন্ধ্যায় পেরিয়ে রাত আমি বিছানায় পা নাড়াচ্ছি। মন্দ কাজের একটা নির্দিষ্ট ডেফিনেশন থাকা উচিত, ভিত্তি থাকা উচিত, যা স্থান, কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তন হবে না।

মানুষ কি নিজের কাজের জন্য দায়ী?

হুম। না হলে আল্লাহ জান্নাত জাহান্নাম সৃষ্টি করতেন না।

তাহলে মানুষ কি নিজের ভালো মন্দ কাজের স্রষ্টা?

না। মানুষ যেইরকম আল্লাহর সৃষ্টি, মানুষের কাজও আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ ক্রমাগত সৃষ্টি করে চলেছেন।

তাহলে মানুষের রোলটা কি?

মানুষ মন্দ কাজ করে। মানুষের সাথে রিলেশানটা কাজটা করার, কাজটা সৃষ্টির না।

মন্দ কাজও কি আল্লাহ’র ইচ্ছাতে হয়?

হুম। আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়। আল্লাহ’র ইচ্ছা দু’ধরনের। একটা শার’ঈ ইচ্ছা—এর সাথে পুরস্কার, শাস্তি জড়িত। অন্যটা সৃষ্টিগত ইচ্ছা—এর সাথে শাস্তি পুরস্কারের সম্পর্ক নেই। যে ভালো কাজ করল, সেক্ষেত্রে দু’ধরনের ইচ্ছাই কার্যকর হয়েছে। মন্দ কাজ সংঘটিত হলে শুধু সৃষ্টিগত ইচ্ছা কার্যকর হয়।

মানুষের কি স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি আছে?

আছে। এটা প্রত্যেকটা মানুষ বুঝতে পারে। আমি যে আজ সারাদিন বিছানায় বসে আছি, এটা আমার ইচ্ছায় হয়েছে।

আল্লাহ ভালো। তিনি কীভাবে মন্দ সৃষ্টি করেন?

মন্দ বিষয়টা রিলেটিভ। আল্লাহ’র মন্দ কাজ সৃষ্টির পিছনেও ভালো কিছু থাকে। পিওর মন্দ বলতে কিছু নেই। যেমনঃ ইবলিশ হল মন্দ। সে আদমকে প্রতারিত করে নিষিদ্ধ ফল খেতে উৎসাহিত করল। মন্দ কাজ সংঘটিত হল। আদম ক্ষমা চাইল। ক্ষমা চাওয়া আল্লাহ’র কাছে ভালো কাজ। আল্লাহ আদমকে ক্ষমা করে দিলেন। মন্দ কাজ না করলে কি ক্ষমা চাওয়ার মতো ভালো কাজ হতো?

তাহলে মন্দ বা রিলেটিভ মন্দ কে কি আমাদের ভালোবাসা উচিত বা চাওয়া উচিত?

আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন তাকেই আমাদের ভালোবাসতে হবে এইরকম কোন ইনডিকেশন কোরআন হাদীসে দেয়া নেই। ইবলিসকে ভালোবাসতে হবে এইরকম কোন ইঙ্গিত নেই।

একই সাথে একটা কাজ মানুষ কীভাবে স্বাধীনভাবে করে, আল্লাহ তা সৃষ্টি করেন আবার আল্লাহ’র ইচ্ছা ব্যতীত কিছু হয়না? ব্যাপারগুলো কীভাবে এডজাস্ট করা হবে।

ব্যাপারগুলা এডজাস্ট করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি। মানুষের পক্ষে আল্লাহ’র কর্ম বা ক্রিয়ার প্রকৃত রুপ বুঝা সম্ভব নয়। মানুষের চিন্তা’র একটা শেষ আছে, এর পরে চিন্তা করলে কেবল মস্তিষ্ক বিগড়ে যাবে, সঠিক লাইনে চিন্তা করা যাবেনা, কারণ লাইনের শেষ প্রান্তের পর কিছু থাকেনা। তাকদীর বা কদর নিয়ে চিন্তা করে বিভিন্ন ফিলসফিকাল থট বের হয়েছে, কিন্তু কেউ এর কুল কিনারা করতে পারেননি। ইসলামে কদর বিষয়ক অতিরিক্ত চিন্তা করতে উৎসাহ দেয়া হয়নি। যে বিষয়ে চিন্তা করে কোন ফলাফল আসবেনা, সে বিষয়ে চিন্তায় লাভ নেই।

Qadar বইটা ৫ বার শেষ করেছি। আজ রাতে ফাইনাল ফিনিশিং দিতে হবে।

মধ্য রাতের পরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আমি আর ভাইয়া ছাদে গেলাম। বৃষ্টি বেশিক্ষণ হলোনা। বাসায় এসে জামা কাপড় চেঞ্জ করলাম। ভাইয়া চুলোয় চায়ের পানি বসিয়েছেন। ড্রয়িং রুমে আওয়াজ শুনে বাবা উঠে এলেন। আমাদের দেখে খুশি হলেন, কালো আসকান পরা ভূত না দেখার খুশি। রাত তিনটা, আমি ভাইয়ার বিছানায় বসে পা নাড়াচ্ছি, আমার এখন পা নাড়ানো ব্যাধি চলমান। ভাইয়া চা বানাচ্ছেন, চায়ের জন্য অপেক্ষমান।

- কিছুক্ষন পরে ছাদে যাবো।
- কেনো?
- ফজর দেখবো।
- মানে?
- ফজর দু’ধরনের। একটা ফজর আল-কাজিব মানে মিথ্যা ফজর, অন্যটা ফজর আস্-সাদিক, মানে সত্য ফজর। একবার আলো লম্বালম্বিভাবে দেখা যায়, ফজরের আলো। অন্যবার আলো পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। মিথ্যা ফজর আগে আসে, মানে এখনো ফজর হয়নি, পরে আসে সত্যটা।

ফজরের অপেক্ষায় আমরা ছাদে। আমার মাথায় শুধু একটা বাক্যই বার বার বাজছে, আগে আসে মিথ্যা ফজর, ফজর আল কাজিব, পরে আসে সত্য ফজর, ফজর আস্ সাদিক…আগে মিথ্যা, পরে সত্য…

[সমাপ্ত]