ভালোবাসার জন্য আমার অনেক কাঙ্গালপনা। কেউ আমার খোঁজ নেবে, আমার সাথে বসে গল্প করবে, আমাকে একটু ভালো করে বুঝবে — এমন আশা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় সুমনের সাথে দু’বছর একই বেঞ্চে বসতাম। একদিন কিছু না বলেই ওরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে কষ্টে কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর অনেকবারই কাঁদতে হয়েছে। অনেক রকম ঘটনায়। আমি ছেলেমানুষ, তাই লোকচক্ষু এড়িয়ে আড়ালে আবডালে চোখের পানি মুছতাম। কেউ দেখে ফেললে হাসাহাসি করবে — সেই আতঙ্ক থাকতো!
আরো কতবার এই হৃদয় যে ভাঙ্গলো, তার ইয়ত্তা নাই। একটা সময় অনেক মনে হতো — আমি খুব অভাগা, তাই আমার দিকে কেউ ফিরে চায়না। আমি অভাগা বলেই হয়ত যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে গুণেও দেখেনা। অজস্র সময় গেছে জীবনে, যখন অন্য কেউ আমার সাথে কথা বললে, আমার খোঁজ নিলে আমার ভালো লাগবে — এই ভেবে ভগ্নহৃদয়ে কেটেছে সময়। অনেক ভাবতাম, কেন আমার জীবন এমন হবে! আমি তো বিশ্বাস করিনা এত দুঃখী আমি হতে পারি। কেনই বা হবো — আমার জীবনের সমস্তটুকু দিয়েই তো আমি আমার সব কাজে প্রচেষ্টা চালাই!
আমার জীবনে আমি কোন বস্তু বা জিনিসের জন্য কষ্ট পেতাম না। একটা ফোন, ল্যাপটপ, খেলনা গাড়ি, ভিডিও গেমের জন্য জীবনেও আমি কষ্ট পাইনি। সেই ছোটকাল থেকে কোনদিন, কখনো না। কিন্তু সম্পর্কগুলো আমার কাছে অনেক বড় ছিলো। আমি বরং আরো ভাবতাম — আমিতো ঠিকমতই সবার সাথে কথা বলি, তবু কেন ওরা আমাকে ভুল বুঝে? কেন সবাই আমার সাথেই এমন করে? — এর চাইতে বেশি ভালো করে, সঠিক করে ভাবার যোগ্যতা ছিলো না তখন। মূলতঃ জ্ঞান ছিলো না। সবসময়ে তাই নিজের অজান্তেই বুকে অদ্ভুত কষ্ট জমে থাকতো। সেখানে ছিলো না পাওয়ার দল, সেখানে ছিলো একাকিত্বের কষ্ট, সেখানে ছিলো কেউ আমাকে না বোঝার কষ্ট, কাউকে আপন করে না পাওয়ার কষ্ট। যেহেতু চাওয়া বলতে কোন বস্তু আর বেড়ানো ছিলো না আমার কাছে, তবু না পাওয়ার এই কষ্ট জমে জমে হতাশায় রূপ নিতো।
আমার জীবনে কখনো কোন একটা পরীক্ষা ভালো হলে, সেটা আমার সুখের কারণ হতো। খারাপ হলে জগতটাই অর্থহীন হয়ে যেতো! কখনো কোন বন্ধু কেন অন্য ৫ জনকে দাওয়াত করলে আর আমাকে না করলে খারাপ লেগে মন খারাপ হতো। ভাইয়া আমাকে একটু তাচ্ছিল্যভরে সমালোচনা করলো — আর তাতে খুব কষ্ট পেলাম। আপু হয়ত আমাকে খুবই ভুল বুঝে বকলো, রাগ করলো — আমার হয়ত আকাশটাই ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। সবকিছু খারাপ লাগতে শুরু করলো কেননা আমার মনে হত আমাকে পারফেক্ট হতে হবে এবং পেতেও হবে। এভাবে, একসময় কষ্ট পেলাম মনের মতন চাকুরি না পাওয়ায়। বন্ধুরা অনেকেই পেয়ে গেলো সেই নামকরা সেরা প্রতিষ্ঠানে — আমিই খালি পেলাম না!!
আজকে একটা ছোটভাইয়ের কথা শুনলাম। মনের মতন ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে সে বিগড়ে গেছে। এই দুঃখে এখন জীবনকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকেই যেতে দিচ্ছে। একটা সময় হয়ত তার আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তবু ভেবে দেখলাম, এমন কষ্ট আমাকেও অনেক পুড়িয়েছিলো। না পাওয়ার বেদনা। ওই ভার্সিটিতে চান্স পেলেই আমি সুখী — না পেলে আমি দুঃখী। এই ছোট ভাইটার মতন অজস্র ভগ্নহৃদয় আমাদের চারপাশে, আমরা সবাই কমবেশি।
কেন সবাই চলে যায়, সবকিছু চলে যায়? কেন এই হারানোর দুঃখগুলো আমাদেরকে এত বেশি পোড়ায়?
এরকম কিছু কথা ইয়াসমিন আপুর লেখায় পড়ার পর আবিষ্কার করলাম পরিষ্কার! সুবহানাল্লাহ! আমি আসলে সবসময়েই আমার সুখ-দুঃখ অন্যের হাতে ছেড়ে দিতাম। আমার সুখ-শান্তির কন্ট্রোল দিয়ে রেখেছিলাম এমন কিছু জিনিসের কাছে — যা নশ্বর। যে/যারা ক’দিন পরে হয়ত নষ্ট হয়ে যাবে, মরে যাবে। সেগুলো পেলে, তারা ঠিক থাকলে আমার জীবন ঠিক। তারা বিগড়ে গেলে — আমিও শেষ!! অথচ যিনি এই সবকিছুর মালিক, তার কথা আমার মনেই থাকেনি। যিনি আমাকে অজস্র জিনিস দিয়ে ঋণী করে রেখেছেন, তার কাছ থেকে হয়ত দু’একটা জিনিস না পেতেই মন খারাপ হয়ে গেলো। অথচ তিনি আমার জন্য প্রতিটি মুহূর্তই সাজিয়ে রেখেছেন।
আরো অদ্ভুত একটা জিনিস হলো — এই চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, না পাওয়ার ভেতর খুব বেশি সুন্দর একটা জিনিস আছে।
একটু অবাক লাগলো?
প্রতিটি বন্ধন ছিঁড়ে যাবার কষ্টের মধ্যে আসলে আমাদের একটা রিমাইন্ডার আছে। আমরা যখন আমাদের আল্লাহকে ছেড়ে একটা চাকুরিকে অনেক দাম দিতে থাকি। অন্য কোন নশ্বর (যা নষ্ট হয়ে যায় একসময়) মানুষকে বা সৃষ্টি বস্তুকে তাঁর চাইতে বেশি করে ভালোবাসায় ডুবে যেতে নিই, ভুল পথে পরিচালিত হই — তখন আল্লাহ আমাদের রিমাইন্ডার দেন। এর ফলে, আমরা যেন আমাদের সুখী-দুখী হবার ক্ষমতা অন্য কারো উপর ছেড়ে না দিই — যেন ফিরে আসি আবার তাঁর কাছে। আল্লাহর সাথে আমাদের যেই সম্পর্ক — সেইটা কি কোনদিন নষ্ট হবার? আজো তিনি আমাদের রব, আমাদের প্রিয়তম — অনন্তকাল কেবল তিনিই আমাদের সবচাইতে কাছের বন্ধু হয়ে থাকবেন। তাঁর সাথে সম্পর্কের কথা ভুলে আমরা কোথায় যাই?
অনেকের হাতে আল্লাহ এই জগতে কিছু ক্ষমতা দেন সাময়িক সময়ের জন্য। যেমন হয়ত রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ আছেন — তার চারপাশে চাটুকারের অভাব হয়না যারা তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে কিছু পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকে। এই ক্ষমতা সেই লোকেরও বেশিদিন থাকে না, চাটুকারদের কথা তো বাদই দিলাম। অথচ যার হতে সব ক্ষমতা, যিনি আসমান জমিনের সবকিছুকে কন্ট্রোল করেন — তার কাছে কি চেয়েছি আমরা অমন করে? অথচ তার একটুখানি প্রিয় হতে পারলে আমরা এই পৃথিবীতেও পাবো তার ভালোবাসায় হৃদয়ে আনন্দের স্পর্শ, অনন্তজগতে কেবলই প্রশান্তি।
প্রেম ভালোবাসার চিন্তায়, একটা মেয়ের কাছে ভালো হতে, তাকে কাছে পেতে কত কিছুই না করে একটা ছেলে। তাকে পাওয়া না পাওয়াতেই জীবন যেন সবকিছু। না পেয়ে অনেকে পাগল হয়ে সেই মেয়েকেও মারে, নিজেও মরে। অথচ এই মানুষটাকে পাবার পরের দিনই সেই মেয়েটি মরে যেতে পারে, হয়ত সে নিজেই মরে যেতে পারে। অথচ সে একটা সম্পর্ককে সবচাইতে বেশি দামি মনে করে জীবনের ক্ষতি আনলো। অর্থহীন একটা কাজ, অর্থহীন সেই অনুভূতি।
এভাবে আরেকটা সৃষ্টির কাছে নিজের সুখ-দুঃখ ন্যস্ত করে আমরা সবসময়েই জটিল করে চলেছি আমাদের জীবন। অথচ আল্লাহ বলেই দিয়েছেন, তিনি কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। নিজ থেকে আমরা বোঝা মাথায় নিয়ে ফেললে আবার তাঁর কাছে ফিরে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
ভেবে দেখেন তো, আপনার হৃদয়ে কি অনেক কষ্ট? অনেক না পাওয়ার বেদনা? আপনার কাছ থেকে কি কিছু হারিয়ে গেছ? চলে গেছে? হাত ফসকে কেউ/কিছু চলে গেছে? ভেবে দেখুনতো, সেই জিনিসটা থাকলেও কতদিন থাকতো আপনার কাছে? ১০বছর? ২০ বছর?
এমন কিছু হারালে বুঝবেন, এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে — হয়ত আসল রিলেশন ছেড়ে ভুল কিছুতে আমরা জড়িয়ে পড়ছিলাম। আল্লাহ আমাদের ভালো চান, তাই একটা ঝাড়া দিয়ে দিলেন। এমন broken heart দের উত্তম ঔষধ হলো — সেই মহান আর প্রিয়তম অন্তরতম জনের কাছে ফিরে যাওয়া – তাঁর কাছে মনের কষ্ট খুলে বলা — যিনি এই বিশ্বজাহানের সমস্ত ক্ষমতা ধারণ করেন, যিনি রাহমানুর রাহিম। যার কাছে তাঁর বান্দা অনুতপ্ত হয়ে ফিরে গেলে তিনি যারপরনাই খুশি হন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সেই বাণীটি আমাদের মনে আছে তো? —
” যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।”
— [সূরা আর রা’দ, আয়াতঃ ২৮]
রেফারেন্স
- Why do people have to leave each other :: Yasmin Mogahed
- People leave each other but do they return? :: Yasmin Mogahed