“যেদিন আপনি দেখবেন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে, তাদের সম্মুখ ভাগে ও ডানপার্শ্বে তাদের জ্যোতি ছুটোছুটি করবে বলা হবেঃ আজ তোমাদের জন্যে সুসংবাদ জান্নাতের, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য। যেদিন কপট বিশ্বাসী পুরুষ ও কপট বিশ্বাসিনী নারীরা মুমিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা কর, আমরাও কিছু আলো নিব তোমাদের জ্যোতি থেকে। বলা হবেঃ তোমরা পিছনে ফিরে যাও ও আলোর খোঁজ কর। অতঃপর উভয় দলের মাঝখানে খাড়া করা হবে একটি প্রাচীর, যার একটি দরজা হবে। তার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে আযাব। তারা মুমিনদেরকে ডেকে বলবেঃ আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবেঃ হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। প্রতীক্ষা করেছ, সন্দেহ পোষণ করেছ এবং অলীক আশার পেছনে বিভ্রান্ত হয়েছ, অবশেষে আল্লাহর আদেশ পৌঁছেছে। এবং সেই চূড়ান্ত প্রতারক তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছে। অতএব, আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপন গ্রহণ করা হবে না। এবং কাফেরদের কাছ থেকেও নয়। তোমাদের সবার আবাস্থল জাহান্নাম। সেটাই তোমাদের সঙ্গী। কতই না নিকৃষ্ট এই প্রত্যাবর্তন স্থল। যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।“ [সূরা আল হাদীদ :১২-১৬]

আল্লাহ্‌ আজ’ওয়াজাল কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন সুরাতে শেষ বিচারের দিনের বর্ণনা দিয়েছেন। কখনো বিস্তারিত, কখনো বা সংক্ষেপে,আবার কখনো রূপকের মাধ্যমে। বিশ্বাসীরা জান্নাতের দিকে ধাবমান এবং অবিশ্বাসীরা জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে --- অধিকাংশ বর্ণনায় এমন একটি চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আলোচ্য অংশে একটি ব্যতিক্রমধর্মী চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা সুরা হাদিদ- এর মাঝামাঝি অংশে রয়েছে। এখানে আল্লাহ্‌ আজ’ওয়াজাল বিশ্বাসী ও মুনাফেকদের ভেতর তুলনা করেছেন। মুনাফেক তারা যারা মনে করে তারা মুসলিম এবং চলনে-বলনে সঠিক পথেই আছে, যদিও তাদের অন্তর কলুষিত। তারা মনে করে তারা ঈমান এনেছে অথবা ভান করে তারা মুসলিম কিন্তু বিচার দিবসে তাদের এই ‘ঈমান’ কোন কাজেই আসবে না। কারণ আল্লাহ’তাআলাই একমাত্র মানুষের অন্তরের খবর রাখেন এবং কোন ভান-ভনিতা সেইদিন ধোপে টিকবে না।

সুরা হাদিদের এই আলোচ্য অংশটি আমাদের জানা খুবই জরুরী, বিশেষ করে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আল্লাহ্‌ পরম দয়ালু এবং অসীম করুণাময় বিধায় বিচার দিনের এই চিত্রটি আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন। তিনি চান আমরা যেন সময় থাকতেই সতর্ক হই, যেন আমরা কেউই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হই।

দৃশ্যটি বর্ণিত হয়েছে এইভাবেঃ “যেদিন আপনি দেখবেন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে, তাদের সম্মুখ ভাগে ও ডানপার্শ্বে তাদের জ্যোতি ছুটোছুটি করবে।“ অর্থাৎ কেয়ামতের প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (‘আপনি দেখবেন’) তাঁর উম্মাহের সকল ব্যক্তিদের দেখতে পাবেন। ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের হৃদয় থেকে এবং ডান হাত থেকে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হবে। এই আলোটি কেন জরুরী? কারণ, যদি আপনার-আমার ঈমান অকৃত্রিম এবং বিশ্বাস দৃঢ় হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে অন্তরে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এবং সর্ব অবস্থায় ব্যক্তির কর্মকে প্রভাবিত করবে। এই বিশ্বাস ও কর্ম জ্যোতিতে রূপান্তরিত হয়ে দীপ্তি ছড়াবে। সেদিন আমাদের কাছে দুইটি টর্চ (আলো) থাকবে, একটি হৃদয়ে (যেখানে ঈমান ও বিশ্বাসের অবস্থান) এবং একটি হাতে (যা দিয়ে কাজ করেছি)। শেষ বিচারের দিনটি হবে নিকষ কালো একটি দিন। আঁধারে ঢাকা বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের জান্নাতে পৌঁছাতে হবে। এবং সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সবার আলোর প্রয়োজন হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিছু কিছু ব্যক্তির আলো হবে অনেক প্রখর। সেই আলো এক শহর থেকে আরেক শহর পর্যন্ত বিচ্ছুরিত হবে। আবার কারো কারো আলো হবে অত্যন্ত অনুজ্বল। সেই টিমটিমে আলোতে নিজ পা কোথায় ফেলছে কোনোমতে শুধু সেটিই দেখতে পাবে। বিভিন্ন মাত্রার আলো নিয়ে যখন বান্দারা জেগে উঠবে এবং জান্নাতের পথে যাত্রা শুরু করবে, তখন আল্লাহ’তাআলার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হবে। কারণ, অন্ততপক্ষে নিজস্ব আলো (যত সামান্যই হোক) নিয়ে এইসকল বান্দা জেগে উঠেছে এবং জান্নাতের পথে যাত্রা শুরু করেছে। “বলা হবেঃ আজ তোমাদের জন্যে সুসংবাদ জান্নাতের, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য”।

পরবর্তী আয়াতেই আরেক শ্রেণীর লোকদের কথা বলা হয়েছে। যারা পৃথিবীতে থাকতে নিজেদেরকে ঈমানদার বলেই দাবী করতো এবং নিশ্চিত ছিল যে জ্যোতি নিয়েই জেগে উঠবে! তারা সেই তমসাচ্ছন্ন ধুধু প্রান্তরে জেগে উঠবে এবং গভীর বিস্ময়ে আবিস্কার করবে পথ চলার জন্য তাদের নিজস্ব কোন আলো নাই! বহু দূরে তারা দেখবে কিছু মানুষ (যদিও তাদের চেহারা পরিস্কার দেখা যাবে না, শুধু আলো দেখা যাবে) আলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু মুনাফেক নারী-পুরুষদের কাছে কোন আলো থাকবে না, তাই দূরের মানুষদের আলো দেখে তারা দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের থেকে আলো ধার নেয়ার চেষ্টা করবে। “যেদিন কপট বিশ্বাসী পুরুষ ও কপট বিশ্বাসিনী নারীরা মুমিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা কর, আমরাও কিছু আলো নিব তোমাদের জ্যোতি থেকে”।

কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন সুরা থেকে আমরা জেনেছি, হাশরের ময়দান হচ্ছে ভয়াবহ এটি জায়গা। সেদিন জন্মদাত্রী মা নিজ সন্তানকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করবে। ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, প্রাণের বন্ধু ----এইসব পার্থিব সম্পর্কগুলো ছিন্ন হবে। প্রতিটি মানুষ শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচাতে উদ্বিগ্ন থাকবে। তাই, স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাসীরা তখন মুনাফিকদের বলবে, “বলা হবেঃ তোমরা পিছনে ফিরে যাও এবং আলোর খোঁজ কর।“ ‘পিছনে ফিরে যাও’ -- একপ্রকার ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য (sarcastic remark)। মুনাফিকদেরকে বিশ্বাসীরা তখন আবার দুনিয়াতে ফিরে গিয়ে আলোর সন্ধান করতে বলবে। কারণ, কেউ যদি দুনিয়াতে তার ঈমান ও কর্ম দিয়ে ‘আলো’ সংগ্রহ না করে থাকে, তাহলে সেদিন তার নিজস্ব কোন আলোই থাকবে না। এবং কোন ‘ধার করা আলো’ তার সেদিন কাজে লাগবে না। এই কথা শুনেও মুনাফিকরা মরিয়া হয়ে মুমিনদের কাছে পোঁছানোর জন্য, পিছন থেকে ধরে ফেলার জন্য ছুটে যাবে। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে, দুই দলের মাঝে একটি বৃহদায়তন ও প্রকাণ্ড দেয়াল নেমে আসবে। এবং দুইদলকে (ঈমানদার এবং মুনাফেক) সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলবে। “অতঃপর উভয় দলের মাঝখানে খাড়া করা হবে একটি প্রাচীর, যার একটি দরজা থাকবে। তার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে আযাব।“ এই দেয়ালের এক দিকে (ঈমানদারদের দিকে) থাকবে আল্লাহ্‌র করুণা, দয়া এবং মমতা । আর অপর দিকে (মুনাফেকদের দিকে) থাকবে কঠোর শাস্তি এবং অন্ধকার। তখন দেয়ালের ঐ পাশ থেকে প্রবল হতাশা নিয়ে মরিয়া হয়ে মুনাফেকরা বলবে, “তারা মুমিনদেরকে ডেকে বলবেঃ আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?”

লক্ষ্য করুন, মুনাফেকরা মুমিনদেরকে বলছে, “আলাম নাকুম মা’আকুম” [আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?] একশ্রেণীর মানুষ যারা পৃথিবীতে নিজেদেরকে ঈমানদার বলেই জানতো, দাবী করতো এবং তারা জান্নাত প্রাপ্তির ব্যপারে একশতভাগ নিশ্চিত ছিল। তারা এতটাই সুনিশ্চিত ছিল যে যখন বিচার দিবসে দেয়ালের অপর প্রান্তে আটকা পড়ে যাবে তখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারবে না যে ঘটনাটা কি হচ্ছে? তাই তখন তারা হতবুদ্ধি হয়ে জানতে চাইবে, “আমরা তো একইসাথে ছিলাম। একসাথে সালাত পড়েছি, ঈদের সালাতের পর কোলাকুলি করেছি, একসাথে কুরবানি দিয়েছি, একইসাথে ইফতার পার্টিতে ইফতার খেয়েছি, ব্যাবসায়িক লেনদেন করেছি, ইসলাম ধর্ম –এ জিপিএ ৫ নিয়ে পাশ করেছি, আমরা তোমাদের প্রাণের বন্ধু/ একই দলের-মাযহাবের-মসজিদের লোক/ পরিবারের সদস্য/ কাজিন-নেফিউ-নিস/ খালা-ফুপু-চাচা-মামা/ প্রতিবেশী ছিলাম। আজকে কেন আমাদেরকে পৃথক করা হল?কেন এই দেয়াল, কেন তোমরা আলো ধার দিচ্ছ না, কেন দরজা খুলে দিচ্ছ না?”

দেয়ালের আরেক পাশ থেকে মু’মিন ও জান্নাতের দিকে অগ্রসরমান ব্যক্তিরা তখন তাদের (মুনাফিকদের) প্রশ্নের উত্তর দিবে। দেয়াল নেমে আসার আগে মু’মিনরা মুনাফিকদের বলেছিল, “তোমরা পিছনে ফিরে যাও এবং আলোর খোঁজ কর।“ দেয়াল নেমে আসার পর এই মু’মিন ব্যক্তিরাই মুনাফিকদেরকে ব্যাখ্যা দেবে, কেন তারা আজ দেয়ালের ঐ পাশে আটকা পড়েছে। একসময় তাদের (মুনাফেক) ভেতরেও আলো ছিল, তাদের ভেতরে ঈমান ছিল। কীভাবে সময়ের পরিক্রমার আস্তে আস্তে সেই আলো নিভে গেছে? কি কারণে তারা শেষ বিচারের দিন সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে হাজির হয়েছে?

এই আয়াতটি বিশেষভাবে নিগূঢ় একটি আয়াত। এই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে একজন মুসলিম ক্রমে ক্রমে ঈমান হারায়। রাতারাতি কোন ব্যক্তির ঈমান ধ্বংস হয়ে যায় না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন ঈমানদার ব্যক্তি মুনাফেক হয়ে যায় না। এটা একটা পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি এই নিরন্তর বানীতে প্রকাশিত হয়েছে --- “balaa wa laakinnakum fatantum anfusakum” অর্থাৎ “তারা বলবেঃ হ্যাঁ (অবশ্যই ছিলে), কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে (ফিতনায় ফেলে) বিপদগ্রস্ত করেছ।“ আরবিতে ফাতানা শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোন কিছুকে পরীক্ষাতে ফেলা। সোনা গলিয়ে তার খাদ ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ করার পদ্ধতিটিকেও ফাতানা বলে। সোনা নিখাদ করার প্রক্রিয়া সহজ নয়, বরং এটি একটি যন্ত্রণাদায়ক দহন প্রক্রিয়া। উচ্চ তাপে সোনাকে গলিয়ে নিলে উপরে খাদ ভেসে উঠে। ধীরে ধীরে সেই খাদ সরিয়ে নিয়ে ক্রমে ক্রমে সোনাকে বিশুদ্ধ করা হয়। ‘fatantum anfusakum’ এর অনেকগুলো ব্যাখ্যা আছে। তবে এই আয়াতটির জন্য একটা বিষয়কে হাইলাইট করবো। ‘তুমি নিজেকে বারংবার জেনেবুঝে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছ, যেখানে তোমার ঈমান পদে পদে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে’ [fatantum anfusakum]। এখানে জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করুন। ঈমানের জন্য ক্ষতিকর হবে জেনেও আপনি বারবার নিজেকে এমন পরিবেশের সম্মুখীন করেছেন, এবং নিজেকে বুঝিয়েছে “আমি এটা সামলে নিতে পারবো, আমার বিপদে পরার বা পদস্খনলনের কোন সম্ভবনা নাই”। আপনি নিজেকে এমনসব বন্ধু/আত্মীয়স্বজন দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন যারা হারামকে হারাম মনে করে না (হারাম খায়, হারাম দেখে/শোনে/পড়ে, মুখ খুললেই নোংরা গালাগালি করে ইত্যাদি), অশ্লীলতাকে আধুনিকতা মনে করে, অশালীনকে আর্ট-কালচার ভেবে পালন করে, শিরক/ বিদ’আতকে হাজার বছরের ঐতিহ্য ভেবে জাঁকজমকের সাথে উৎযাপন করে। কিন্তু আপনি নিজেকে বোঝাচ্ছেন, “আমি ওদের মত না, আমি শুধু ওদের সাথে থাকি। ওরা আমাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। নো ওয়ে“! এবং আপনি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সেইসব ‘বিপদজনক বন্ধু/আত্মীয়-স্বজন’ দের সাথে মিশছেন, ওঠাবসা করছেন। আপনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, “এইসব আমার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না।“ প্রসঙ্গত, আরেকটি উদাহরণ দেই। অনেক মুসলিম অভিভাবক তাদের নিজেদের সন্তানদেরকে ঈমানের এই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় (ফিতনায় ভেতর ঠেলে দিয়ে বিপদগ্রস্ত করে)। ফিতরাতের উপর জন্মানো কোমলমতি সন্তানদেরকে নাচ শেখায়, গান গাইতে পাঠায়, মডেলিং করতে দেয়। আর্ট-কালচার এর এই রাস্তাগুলো শিশু সন্তানদের জন্য কি পরিমাণ ক্ষতিকারক এবং অরক্ষিত সেটা জানা সত্ত্বেও তারা এই কাজটি করে। শিশুটি ভোরে উঠে গলা সাধে, স্কুল থেকে এসে হুজুরের কাছে কায়দা/কুরআন পড়ে, বিকালে নাচ শিখতে যায় আর রাতে বাবা-মায়ের সাথে বসে টিভিতে ক্ষুদে গানরাজ/ নাচো বাংলাদেশ নাচো/ লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা দেখে সেলিব্রেটি হওয়ার স্বপ্ন দেখে!

প্রকৃতপক্ষে, ঈমান ধ্বংসের সর্বপ্রথম ধাপটাই হচ্ছে অসৎ সঙ্গ! ঈমান বজায় রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হবে জেনেও দিনের পর দিন আমরা এমন সব জায়গায় যাই এবং এমন সব ব্যক্তির সংশ্রবে থাকি, মেলামেশা করি। যখন দীর্ঘ সময় ধরে কেউ এই ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে বা নিজ সন্তানকে ফেলে তখন যা ঘটে, সেটা একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বলছি।

বাসায় যখন অনেক তেল-মসলা দিয়ে রান্না করেন, তখন সারা বাড়িতে সেই গন্ধে ভরে যায়। আপনি বাসার ভেতর থেকে এই গন্ধ বুঝতে পারবেন না। কিন্তু যখন বাইরে থেকে একজন বাসায় প্রবেশ করে, প্রথম সে একটা ধাক্কার মত খায় (বিশেষ করে যারা এই গন্ধের সাথে অভ্যস্ত নয়)। যে রান্নার গন্ধে হয়ত আপনার জিভে পানি আসছে, সেই একই গন্ধে বাইরে থেকে আসা ব্যক্তির দমবন্ধ হয়ে যায়। সে তখন ফ্রেস বাতাসের জন্য জানালা-দরজা খুলতে অনুরোধ করবে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষন পর সে নিজেও এই গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ঠিক একইভাবে, যখন কেউ খারাপ পরিবেশে প্রবেশ করে বা অসৎ সংগের সাথে মেলামেশা শুরু করে। প্রথম প্রথম সে ঠিকই অনুভব করে “সামথিং ইজ নট রাইট”, “আমার এখানে থাকা ঠিক হবে না” “ইটস গোয়িং টু ম্যাস মি আপ”। একদম শুরুতে তার মনের ভেতর ঠিকই খচখচ করবে, মনে হবে কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে আছে, দমবন্ধভাব হবে। কিন্তু কিছু দিন/সপ্তাহ/মাস পর সবকিছু তার কাছে সয়ে যাবে। মনের ভেতর বিঁধে থাকা কাঁটাটা আর অনুভব করবে না। কোন অধূমপায়ী ব্যক্তিকে যখন প্রথমবারের মত কোন ধূমপায়ীর পাশে বসিয়ে দেই। তখন সিগারেটের গন্ধে সে কাশতে থাকবে, চোখ জ্বালা করে চোখ দিয়ে পানি আসবে, ফ্রেস বাতাসের জন্য সে ছটফট করবে, এবং সে দ্রুত সেই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে চাইবে। কিন্তু কিছুদিন সেই ধূমপায়ীর সাথে যদি সে বসবাস করে এবং নিজেও সিগারেট/গাঁজা ধরে ফেলে, তাহলে এই একই ধোঁয়া তার কাছে ফ্রেস অক্সিজেনের মত মনে হবে এবং এটা ছাড়া তার জীবনই অচল হয়ে যাবে। তাই, সর্বপ্রথম ধাপটা হচ্ছে ‘fatantum anfusakum’ [বারংবার জেনেবুঝে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছ, যেখানে তোমার ঈমান পদে পদে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে]।

ঈমান হারানোর পর্যায়ক্রমিক ধারার দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে ‘wa tarabbastum’। “তোমরা (সব সময় সুযোগের) প্রতীক্ষা করেছ/দীর্ঘসূত্রতা করেছ”। এখানে দীর্ঘসূত্রতা বলতে কি বুঝিয়েছে? তুমি তোমার অন্তরে অনুভব করছো/ঠিকই বুঝতে পারছো যে পরিবেশে তুমি আছো, যাদের সাথে মেলামেশা করছো, যেসব জায়গায় যাচ্ছ (পার্টি/উৎসব/অনুষ্ঠান), যেসব কাজ করছো---- সেগুলো ভালো না। তুমি বুঝতে পারছো যে তুমি একটা খারাপ সংশ্রবে জড়িয়ে যাচ্ছ, তোমার পরিবর্তন প্রয়োজন, দ্রুত এই কুসঙ্গ ত্যাগ করা প্রয়োজন। সব জেনে-বুঝে তুমি অলসভাবে দীর্ঘসূত্রতা করছো।

নিজেকে বুঝিয়েছঃ

“বেশী না, আর একটা সেমিস্টার/দুটো মাস এই ‘ম্যসট আপ’ বন্ধুদের সাথে থাকবো, তারপর আমি অন্য কোর্স নিব। এখন ওদেরকে রাগানো ঠিক হবে না”।

“শুধু প্রম নাইট/গ্রাজুয়েশন পার্টি/ র‍্যাগ ডে/নবীন বরন – এই একটাতেই যাবো, এটাই শেষ”।

“সবাই মিলে পূজা দেখতে যাচ্ছে/ক্রিসমাস পার্টিতে যাচ্ছে/ হ্যালোইন এর পার্টিতে চাচ্ছে। ওরা আমার বন্ধু/কলিগ/প্রতিবেশী --- একসাথে থাকি। আমি কীভাবে না বলি? তাছাড়া মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা একই সমান। আর শুধু দেখতে গেলে কি হয়? আমি তো আর পূজা করছি না। আমি বিশ্বাস করি ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ ”!!

“আরে বাবা! একটা বিয়ার/একটা ককটেল/একগ্লাস ওয়াইন --- এটা এমন কি? আমি তো মাতাল হচ্ছি না।“ “ সিগারেটে টান দিলে কি মানুষ খারাপ হয়ে যায়? আমি নামায পরি না? গাঁজা/শীশা তো কত ফকীর-দরবেশরাও (!) টানে, তারা কি ধর্মকর্ম কম জানে?”

“এই নয়/দশ মাস পরেই তো রামাদান। রামাদানে সব ছেড়ে দিব। পুরাই চেইঞ্জ হয়ে যাবো। ম্যাচিং আবায়া-হিজাব কিনে রেখেছি, এই রামাদান থেকেই শুরু করবো। এক ওয়াক্তের নামাযও মিস হবে না।“

“এখনো তো অনেক সময় আছে। একটু বয়স হোক। দাড়ি রাখবো। হজ্ব করবো। তার আগে সুদ/ঘুষ খেয়ে নেই। হজ্ব থেকে ফিরে রেগুলার যাকাত দিব, একদম ব্র্যান্ড নিউ মুসলিম হয়ে যাবো। এখন বরং আমার জন্য দোয়া করতে থাকো”।

এটাই ‘wa tarabbastum’। সব জেনেশুনে তুমি শুধু খারাপ সংশ্রবে জড়িয়েই যাচ্ছ। উপরন্তু, সব কিছু বোঝার পরও তুমি আজকেই/এই মুহূর্তে নিজেকে পরিবর্তনের জন্য পজিটিভ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত না। বরং অপেক্ষায় আছো, “ভাবছো আমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে, নিজের উপর আমার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে, I can handle it, let me enjoy little bit more and I will be just fine !” তারা নিজের সাথে প্রথম ভান বা আত্মপ্রবঞ্চনা করছে এই ভেবে যে ‘fatantum anfusakum’। “কুসঙ্গের সাথে থাকলে আমি কোনভাবেই প্রভাবিত হবো না, নিজের উপর আমার একশতভাগ নিয়ন্ত্রণ আছে”। কিন্তু সত্য হচ্ছে, খারাপ সঙ্গ আসলে তাদেরকে প্রভাবিত করছে। তারা দিন দিন খারাপের সাথে থেকে ডিসেন্সেটাইজ হয়ে যাচ্ছে। একবছর আগেও যে জিনিস দেখলে চোখ সরিয়ে নিত, যে কথা শুনলে বমিবমি ভাব হতো। এখন আর সেইরকম বোধ হয় না, এইসবই এখন অতি সাধারন মনে হয়। এর হাত ধরে আসছে, দ্বিতীয় ভান ‘wa tarabbastum’। “আমার হাতে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার যথেষ্ট সময় আছে। আর কয়েকটা দিন মাত্র, তারপর আমি সংশ্রব ত্যাগ করবো”। তারা নিজেদের ভেতরে তাগিদ অনুভব করছে যে এখান থেকে তার বের হয়ে আসা উচিত। কিন্তু জেনেশুনে সে খারাপ সংশ্রব ত্যাগ করছে না। তারা ভাবছে যেকোন সময় তারা রাশ টানতে পারবে। যখনই চাইবে তখনই তারা কুসঙ্গ ত্যাগ করতে পারবে। “আমি এডিকটেড না, আমি ওদের মত কক্ষনই হবো না। আমি এই ফাঁদে কখনোই পরবো না, বরং যেকোন সময় ইচ্ছা করলেই বেরিয়ে যেতে পারবো”। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা যা ভাবছে সেটা ঠিক না। ‘wa tarabbastum’ এর সবচেয়ে ভয়াবহ পরিনাম হচ্ছে, তারা যতবেশী সময় সেখানে থাকবে, ততবেশি জড়িয়ে যাবে, ততবেশি এডিকটেড হয়ে যাবে, ততবেশি তার পক্ষে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব হবে। এবং একসময় সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, সম্পূর্ণ ডুবন্ত অবস্থায় নিজেকে আবিস্কার করবে। একটা সময় খারাপ সংশ্রবের বাইরে যে ভালো কিছু ছিল, সেটাই সে বিস্মৃত হবে। এবং একসময় সে নিজেকে বলে, “অনেক দেরী হয়ে গেছে”! তখন তার ভেতর একধরনের অপরাধবোধ, জন্মাবে। “I am pretty messed up. আমি বহুদিন ধরে এত এত পাপ কাজ করে আসছি। আমার আরও অনেক আগেই তাউবা করা উচিত ছিল। এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা নাই”।

নিজকে খারাপ ভাবতে অথবা মনে ভেতর অনুশোচনা নিয়ে বেশীদিন কাটাতে কেউই পছন্দ করে না। মনের যখন এহেন নড়বড়ে অবস্থা চলছে ঠিক তখন শয়তান এসে বলবে, “তুমি এতো অপরাধবোধে ভুগছ কেন? তোমার তো কোন দোষ নাই। এই ‘ইসলাম’ নামের জিনিসটাই তোমার মনের ভেতরে যত অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছে। আসলে সব দোষ এই ইসলামের। এই ইসলাম বলছেঃ এটা হারাম, ওটা গুনাহ, এটা পাপ, এভাবে কথা বলবে না, ওটা খেও না, অমুকটা দেখ না, ওখানে যেও না, ব্লা ব্লা ব্লা…। এই ইসলাম তোমাকে নিজের সম্পর্কে খারাপ ধারনা দিচ্ছে, অথচ আমি (শয়তান) চাই তুমি নিজের সম্পর্কে ভালো ধারনা করো। তোমার জীবনটাকে তুমি উপভোগ কর। দুইদিনের এই দুনিয়া, যদি ‘মজাই’ না করলে তাহলে জীবনের অর্থ কি, বল? আচ্ছা, এই ইসলাম যে এত কঠিন সব নিয়মকানুন মেনে চলতে বলছে, এটা সত্য কিনা তুমি কি নিশ্চিত? নাকি তোমার জীবনকে যেন ইচ্ছামত উপভোগ করতে না পারো, তার বিরুদ্ধে শুধুই চক্রান্ত?” শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা শুনে বিভ্রান্ত ব্যক্তি ভাববে, “আমি আসলে কেন ইসলামে বিশ্বাস করি? এই ইসলামের কারণেই আমার জীবনটা যতসব নিয়মকানুনের বলয়ে বাঁধা পড়ে আছে। ইসলাম চায় না আমি আনন্দে থাকি। এত নিষেধ/বাধার ভেতরে থাকা যায় না। আমি স্বাধীন চিন্তার মানুষ, মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথে এই ইসলামই একমাত্র বাধা। আমি স্বাধীন ভাবে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মৌজমাস্তি করে, জীবনকে সর্বচ্চ উপভোগ করতে চাই। আমার মনেহয় না কুরআনের সব কথা ঠিক। আল্লাহ্‌ বলে কেউ আছে কিনা এই ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। আমি বুদ্ধিমান-যুক্তিবাদী মানুষ, না দেখে কোন জিনিস বিশ্বাস করি কীভাবে? আর এই হাদিস জিনিসটাই বা কি? এই কুরআন-হাদিস কতটা নির্ভরযোগ্য?” আমাদের আশেপাশে এইরকম বিভ্রান্ত অবস্থায় অনেক আব্দুল্লাহ, জায়নাব, আলী, ফাতিমা, আব্দুর কারিম, আহমেদ, রুকাইয়া, হামজাহ, আই’শা, মুহাম্মদ --- এইসব চমৎকার আরবি নামধারী তরুন-তরুণীদের আমরা দেখতে পাই। তারা খুব নির্ভীকভাবে বলে, “ইসলাম নিয়ে আমার মনে অনেক সন্দেহ আছে। কুরআন-হাসিসের নির্ভরযোগ্যতা, আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব নিয়ে আমার মনে অনেক সংশয় আছে। আমি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, তাই বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি যে, মাদার নেচার থেকে আমাদের সৃষ্টি। আমার পরদাদার দাদার বাবা শিম্পাঞ্চি ছিল, ব্লা ব্লা ব্লা …..“। মজার ব্যপার হচ্ছে, ইসলামিক ফিলসফিতে অথবা কুরআনিক এরাবিকে দুই-তিনটা পিএইচডি বা ইসলামিক/হাদিস শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় বহুবছরের লেখাপড়ার ফলশ্রুতিতে যে তাদের মনে এমন সংশয়ের জন্ম নিয়েছে --- তা কিন্তু নয়। বরং এদের অধিকাংশের একাডেমিক শিক্ষায় ঐচ্ছিক বিষয়ও ইসলাম ধর্ম ছিল না! কোনদিন তারা অর্থ বুঝে কুরআন পর্যন্ত পড়ে নাই! এরা নিজেদের জন্য জেনে-বুঝে কুসঙ্গ এবং অসৎ পরিমণ্ডল বেছে নিয়েছিল। এবং ধীরে ধীরে সেই বিষাক্ত পরিবেশ তাদের গ্রাস করেছে এবং বিভ্রান্তির দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। আমাদের চারপাশে এইরকম হাজার-হাজার তরুন-তরুণী আছে, যাদের আমরা চিনি, তারা আক্ষরিক অর্থে এই আয়াতের ভেতর জীবনযাপন করছে!!

তারা তাদের বিভ্রান্তি থেকে উদ্ভূত হাজারটা প্রশ্ন করতে থাকবে। আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ হতে না হতেই আরেকটা প্রশ্ন করবে। কোন উত্তরেই তারা সন্তুষ্ট হবে না, কোন উত্তরেই তাদের সন্দেহ কাটবে না। কারণ তাদের কোন স্বদিচ্ছাই নাই যেন তাদের বিভ্রান্তি কেটে যায়। আপনি উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ভাববেন আসলে এদের সমস্যাটা কি? তখন যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, “কতদিন থেকে তোমরা এই অসৎ পরিমণ্ডল জেনেশুনে বেছে নিয়েছ?” তখন আপনি বুঝতে পারবেন এদের আসল সমস্যা কোথায়। তারা প্রকৃতপক্ষে ঈমান হারানোর পর্যায়ক্রমিক ধারার তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গেছে, ‘wartabtum’ অর্থাৎ « (নানা রকমের) সন্দেহ পোষণ করেছ »। এই ধরনের সংশয় বা অবিশ্বাস মনের ভেতরে ক্রমেই বাড়তে থাকে। সে অনুশোচনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেকে বিভিন্নভাবে বোঝাবে। “It’s not really truth anyway. I am not absolutly convienced. I don’t find it logical anyway. So, I should not feel bad that I don’t follow it.”

যখন তাদের মনে সন্দেহে দানা বাঁধতে থাকে। এবং সময়ের পরিক্রমায় এই ‘দানা’ দেয়ালে পরিণত হয়। তখন তারা এই দেয়ালের আড়ালে নিজেকে লুকাবে এবং নানাপ্রকারের অনৈতিক কাজ করবে, অশ্লীলতাকে সমর্থন দিয়ে যাবে এবং পুরোপুরি ফিতনায় নিমজ্জিত হবে। যখন কেউ এই পর্যায়ে পৌঁছাবে, তখন দুটো জিনিস তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়া হবে।

১) জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পাওয়ার ইচ্ছা, ‘আল্লাহ্‌ খুশি হবেন’ – এমন কাজ করার তাগিদ, অন্তরে সেই বিশেষ নূর ধারণের স্পৃহা (যা শেষ বিচারের দিনে পথ চলতে সাহায্য করবে) --- এইসব কিছু পাওয়ার বাসনা হারাবে।

২) জাহান্নামের ভয় হারাবে।

আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা এবং জাহান্নামের আতংক --- এইদুটো মুল্যবান বোধ তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়া হবে। এই ব্যক্তির কাছে এখন আখিরাত বা বিচারদিবসের কোন মুল্য নাই। কেউ তার সামনে জান্নাত-জাহান্নাম-শেষ বিচার এর কথা বলতে এটা তার কাছে তামাশা মনে হবে, এমনকি এইসব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।

যখন কারো অন্তর থেকে আখিরাতের প্রাপ্তির আশা হারিয়ে যায় এবং জাহান্নামের শাস্তির ভয় মন থেকে দূর হয়ে যায়, তখন কি হয় জানেন ? তখন তার কাছে শুধু একটা জিনিসই গুরুত্ব পায়, দুনিয়া! সে তখন মনেপ্রাণে পুরোপুরি দুনিয়ামুখী হয়ে যায়। যাকে আদর করে সেকুলার ডাকা হয়। যেহেতু পরকাল বলে কিছু নাই, তাই এই দুনিয়াতেই যা কিছু করার/পাবার জন্য মরিয়া হয়ে যেতে হবে। অর্থ, বিত্ত, সাফল্য, সম্পদ, জনপ্রিয়তা, বিনোদন, মৌজ-মাস্তি, সব ধরনের ম্যাটেরিয়াল থিং --- যে কোন ভাবে, যে কোন পথে অর্জন করাটাই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সে ভাববে দুনিয়াদি এইসব প্রাপ্তি ভেতরেই রয়েছে সব আনন্দ ও চূড়ান্ত মানসিক তৃপ্তি। তাই, পরবর্তী ধাপটি হচ্ছে ‘wa gharratkumul amaaniyyu’ অর্থাৎ “অলীক আশার (দুনিয়ার মোহ) পেছনে বিভ্রান্ত হয়েছ”।

এই পর্যায়ে এসে সে শুধু দুনিয়াদি প্রাপ্তির প্রতি ঝুঁকে পরে। একটা থেকে আরেকটা জিনিসে সে মানসিক শান্তি খোঁজে। কারো জন্য সেটা হয় নেক্সট বক্সঅফিস হিট মুভি / নেক্সট কনসার্ট / নেক্সট স্মার্ট ফোন / নেক্সট টয় বা সুপারহিরোর একশন ফিগার/ ডিজাইনার ড্রেস-জুতা-গহনা/ গুচির ব্যাগ-আরমানির স্যুট-লাসের মেইকআপ কিট / নেক্সট পিএসপি গেইমবক্স ইত্যাদি। কারো আবার টয়োটা আছে তো মার্সিডিশ চাই / এইবার কক্সবাজার তো পরেরবার থাইল্যান্ড আর তারপর ইউরোপ ত্রিপ / উত্তরাতে বাড়ি আছে কিন্তু এখন মালয়শিয়া বা দুবাইতে এপার্টমেন্ট চাই, আরও কত কি! এ্যপেল স্টোরের সামনে নতুন মডেলের আইফোন কেনার লাইন বা সর্বশেষ স্টারওয়ার/ হ্যারি-পটার মুভি দেখার জন্য টিকেটের লাইন এখন হজ্বের জন্য পাসপোর্ট অফিসের সামনের লাইন থেকে অনেক অনেক লম্বা হয়। কোন মুভির ওপেনিং নাইট দেখতে না পারলে জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে! শুধু দেখতে পারলেই ভাবে ‘জীবনের অর্থ’ খুঁজে পাবে! সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আসলে যদি জানতে চান “কেমন লাগলো”? চোখ বড় বড় করে বলবে, "It was pretty awesome"!! পরক্ষনেই আবার বিষণ্ণ হয়ে যাবে। নিজেকে প্রশ্ন করবে, “এখন কি করবো? আবার দেখবো মুভিটা?!” এইভাবে জীবনভর এইসব জিনিসের পেছনেই তারা ঘুরে বেড়ায়, ভাবে ‘এটা’ বা ‘ওটা’ পেলেই বিষণ্ণতা কাটবে, মানসিক তৃপ্তি মিলবে। কোন কিছুতেই তাদের শান্তি মিলবে না বা হতাশা কাটবে না। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা তাদের থেকে তুলে নেয়া হয়েছে, আর প্রকৃতপক্ষে এতেই ছিল আসল মানসিক তৃপ্তি। এখানে এটাই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘wa gharratkumul amaaniyyu hatta jaaa'a amrul‘ অর্থাৎ “অলীক আশার (দুনিয়ার মোহ) পেছনে বিভ্রান্ত হয়েছ, অবশেষে আল্লাহর আদেশ পৌঁছেছে”। তাই আল্লাহ’তাআলা এখানে বলছেন, ‘wa gharrakum billaahil gharoor’ অর্থাৎ “এবং সেই চূড়ান্ত প্রতারক তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছে”। ‘Gharoor’ এখানে মু’বালাগা। ইবলিশ এবং তার নির্দেশিত পথটাই চূড়ান্ত প্রতারক এখানে, যা মুনাফিকদেরকে আল্লাহ্‌ সম্পর্কে বিভ্রান্ত করে প্রতারিত করেছে ।

এইভাবে মুনাফিকদেরকে তাদের ঈমান হারানোর পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াটি মু’মিন ব্যক্তিরা ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা দেবে। যেটা শুরু হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে একটা ছোট্ট পদক্ষেপ থেকে, অসৎ সঙ্গ! এবং সেখান থেকে এটা একটা অটোমেটিক ডাউনওয়ার্ড স্পাইরাল সিঁড়ি, শুধুই নিচের দিকে নেমে যাওয়া! ঘুরে না দাঁড়ালে, আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চেয়ে হিদায়াতের জন্য প্রার্থনা না করলে আল্লাহ্‌র চূড়ান্ত আদেশ না আসা পর্যন্ত এই বিভ্রান্তিতেই আজন্ম বসবাস করতে হবে।

সম্মানিত পাঠকগণ, এতক্ষণ উপরে যা পড়লেন তাকে হালকা ভাবে নেয়ার কোন অবকাশ নাই। এটি একটা ভয়ানক এবং আপাতঃ অবিশ্বাস্য দৃশ্য যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি আল্লাহ্‌ সুবাহান’তাআলার তরফ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি উপহার। সেই বিশেষ দিনে জানার আগে এখন জানাটা কি উত্তম নয়? কল্পনা করুনঃ শেষ বিচারের দিনে সেই অন্ধকার প্রান্তরে দেয়ালের একপাশে আপনি আটকা পরে আছেন। আপনি দিশেহারা, আতঙ্কিত, আশাহত এবং মুহ্যমান। হাজারটা প্রশ্ন আপনার মাথায়, “আমি কীভাবে এই অমুল্য সম্পদ (ঈমান) হারালাম? ”আমার অন্তরের আলো কীভাবে মরে গেল”? “কেন আমার সাথীদের কাছে নূর আছে আর আমার কাছে নাই”? কীভাবে এটা সম্ভব হলো”? তখন দেয়ালের অপর পাশ থেকে আপনার বিশ্বাসী সাথীরা ধাপে ধাপে বর্ণনা করবে, কেন আপনি দেয়ালের ঐ পারে আটকে গেছেন! ভাবতে পারেন, তখন কি সীমাহীন আফসোস হবে আপনার। হয়ত মনেমনে ভাববেন “ইশ! আগে যদি একটু জানতাম এমনটা হবে। যদি কেউ আগে সতর্ক করতো!” অথচ, কুরআনের উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন তাঁর নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। এবং আলহামদুলিল্লাহ্‌ আপনি এটা পড়ছেন। তার অর্থ, ভুল সংশোধনের এখনো পথ খোলা আছে! আল্লাহ’’তাআলা তাঁর প্রতিটি বান্দাকে এই নূর দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই নূরকে অন্তরে এবং কর্মে ধারন করতে পারছি কিনা? আসুন, আমরা সবাই আগে নিজের দিকে তাকাই। ঈমান হারানোর পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াটির কোন ধাপে ‘আমি নিজে আছি’, সেটা অনুসন্ধান করি। হতে পারে আপনি মাত্র প্রথম ধাপে অর্থাৎ অসৎ সঙ্গের (ফিতনাময় পরিবেশে) সাথে মেলামেশা শুরু করেছেন। কিম্বা দমবন্ধ ভাব কেটে যাওয়ার পরে এখন “আজ না কাল, কাল না পরশু” বলে দীর্ঘসূত্রতা করছেন। অথবা আপনি এখন বিভ্রান্তির ধাপে পৌঁছে গেছেন, হাজারটা প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন এবং কোন উত্তরেই সন্তুষ্ট হচ্ছেন না। হয়ত এখন আপনার উপর থেকে দুটো রাহমা [আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পাওয়ার ইচ্ছা এবং জাহান্নামের ভয়] তুলে নেয়া হয়েছে। এমনও হতে পারে আপনি এখন শেষ ধাপে আছেন, তাই শুধু দুনিয়াদি জিনিসের (toys, pleasure, entertainment etc.) মাঝেই আপনি চূড়ান্ত সাফল্য ও মানসিক প্রশান্তি খুঁজে বেড়ান। ডাউনওয়ার্ড স্পাইরাল সিঁড়ির যে ধাপেই থাকুন না কেন, আসুন আমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তিনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে ক্ষমা করবেন, তিনি রাহমানুর রাহিম।

আমাদের যা কিছু অর্জন অথবা উপার্জন, শেষ বিচারের দিনে এইসব কিছু হবে মূল্যহীন। শুধু একটা অর্জনই আমাদেরকে সেই বিশেষ দিনটিতে সাহায্য করবে সেটা হচ্ছে এই জ্যোতি। যদি বিশ্বাস দৃঢ় এবং ঈমান অকৃত্রিম হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে অন্তরে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এবং সর্ব অবস্থায় ব্যক্তির কর্মকে প্রভাবিত করবে। এই বিশ্বাস ও কর্ম জ্যোতিতে রূপান্তরিত হয়ে দীপ্তি ছড়াবে। আর এই মহামুল্যবান জ্যোতি সেদিন আঁধার প্রান্তরে আমাদেরকে পথ দেখাবে। তাই এই অনুচ্ছেদের প্রথমে আল্লাহ’তাআলা তাকে আলোর সাথে তুলনা করেছেন। কুরআনের আরেকটি সুরায় যেমনটি বলা হয়েছেঃ

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ

إِلَّا مَنْ أَتَى ٱللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

বাংলা ভাবার্থঃ যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে। [সূরা আশ-শো’আরা ২৬: ৮৮-৮৯]

আর বাকী যাকিছু নিয়ে আমরা এই দুনিয়াতে গর্বিত হই, অহংকার করি, অন্যকে ছোট করি --- শেষ বিচারের দিন আল্লাহ্‌র সামনে সবই গুরুত্বহীন। কিছুদিনের জন্য আমরা এইসব উপভোগ করতে পারি, কিন্তু যদি এর ফাঁদে আটকে যাই তাহলেই পতনের শুরু। ধীরে ধীরে দুনিয়াদি প্রাপ্তিগুলো আমাদের অন্তরে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি দখল করে নিতে থাকে। একসময় এই অমূল্য জ্যোতির জায়গাটিও দখল হয়ে যায় এবং কালক্রমে অন্তরের আলোটি মরে যায়। আর তাই এরপরের আয়াতে আল্লাহ’তাআলা বলছেন, ‘Fal Yawma laa yu'khazu minkum fidyatunw wa laa minal lazeena kafaroo; maawaakumun Naaru hiya maw laakum wa bi'sal maseer’ অর্থাৎ “অতএব, আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপন গ্রহণ করা হবে না। এবং কাফেরদের কাছ থেকেও নয়। তোমাদের সবার আবাস্থল জাহান্নাম। সেটাই তোমাদের সঙ্গী। কতই না নিকৃষ্ট এই প্রত্যাবর্তন স্থল”। এই আয়াতের সবচেয়ে ভীতিকর অংশ হচ্ছে “তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপন গ্রহণ করা হবে না। এবং কাফেরদের কাছ থেকেও নয়”। আল্লাহ্‌র সামনে এখন আপনি এবং একজন কাফের সমমর্যাদা সম্পন্ন! একজন কাফেরের যে পরিণতি, আপনারও সেই একই পরিণতি, একই শাস্তি, একই আগুনের তাপ, একই আবাসস্থল – জাহান্নাম! অথচ দুনিয়াতে থাকতে আপনি ভেবেছিলেন “ফ্যমিলি নেইম যখন ‘ইসলাম’, আমার জান্নাতে যাওয়া আটকাবে কে”?! হায়! ভেবেছিলেন কি আর কোথায় এসে পৌঁছালেন। কতই না নিকৃষ্ট এই প্রত্যাবর্তন স্থল!

এখন প্রশ্ন হচ্ছেঃ কীভাবে আমরা নিজেদের ভেতরের এই জ্যোতিকে উজ্জীবিত করবো? কোন উপায়ে সেই অটোমেটিক ডাউনওয়ার্ড স্পাইরাল সিঁড়ি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবো? কীভাবে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এই মহামূল্যবান জ্যোতিকে অন্তরে এবং কর্মে ধারন করতে পারবো? যা কিছু নূর এখনো অন্তরে অবশিষ্ট আছে তাকে আর হারিয়ে যেতে না দিয়ে সংরক্ষণ করবো অথবা বাঁচিয়ে রাখবো? শেষ বিচার দিবসের এই পূর্ণচিত্র তুলে ধরার পর আল্লাহ্‌ সুবাহান’তাআলা আলোচ্য অংশের সর্বশেষ আয়াতের উপসংহারে এর উত্তর দিয়েছেন। “Alam yaani laillzeena aamanooo an takhsha'a quloo buhum lizikril laahi wa maa nazala minal haqqi” অর্থাৎ “যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি”?

যখন আমরা আল্লাহ্‌কে স্মরণ রেখে তাঁর বিধান মেনে সৎ ও পরিশুদ্ধ জীবনযাপন প্রণালীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করবো তখনই আমাদের মাঝে প্রকৃত সত্যকে দেখার ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতা ও অনুধাবনের ক্ষমতা জন্মলাভ করে। সত্যের আলো, ন্যায়ের আলো, কল্যাণের আলো আমাদের অন্তরকে আলোকিত করে। ফলশ্রুতিতে আমাদের হৃদয় বিকশিত হয়। পরিণত হই বিবেকবান, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন, অনুভূতিশীল এক উন্নত আলোকপ্রাপ্ত মানুষে। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র স্মরণে আমরা এই জ্যোতিপ্রাপ্ত হবো, কারণ সুরা নূর – এ বলা হয়েছে “Allaahu noorus samaawaati wal ard” অর্থাৎ “আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি”। [২৪:৩৫] আমরা যতবেশী আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবো, এই জ্যোতি ততবেশী বৃদ্ধি পাবে আমাদের অন্তরে। কীভাবে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবেন? “যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে” -- অর্থাৎ কুরআন এর মাধ্যমে। কুরআন পড়বেন অর্থ বুঝে, প্রতিটি আয়াত নিয়ে চিন্তা করবেন। আল্লাহ্‌র দেয়া নির্দেশ-উপদেশ-নিষেধ-বিধানগুলো মেনে চলবেন, নিজের ভুলের জন্য বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন, কান্নায় ভেঙে পড়বেন, যেভাবে কুরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলগন করেছেন। আমাদের জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে কত বড় একটি উপহার এই কুরআন, সেটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। কারণ, সুরা তাগাবুন - এ কুরআনকেও নূর বলে অভিহিত করা হয়েছে, “Fa-aaminoo billaahi wa rasoolihee wannooril lazeee anzalnaa” অর্থাৎ অতএব তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল এবং অবতীর্ন নূরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর”।[৬৪:৮] তাই নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণের জন্য যত বেশী কুরআন পড়বো, কুরআনের সাথে সময় কাটাবো এবং নিজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআনের শিক্ষাকে যতবেশী কাজে লাগাবো, ততই এই মহামূল্যবান জ্যোতিকে অন্তরে এবং কর্মে ধারন করতে পারবো। এর চাইতে আর কোন শ্রেষ্ঠ ভবিষ্যতের সঞ্চয় হতেই পারে না। এই নূর যে কত বড় সম্পদ, সেটা আমি- আপনি-আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারবো না। শুধু সেই বিশেষ দিনটিতে আমরা অনুভব করতে পারবো, মরিয়া হয়ে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবো, যেদিন আমাদের চারপাশ নিকষ আঁধারে ঢাকা থাকবে, পথ চলতে সাহায্য করবে শুধু যার যার নিজস্ব অন্তর ও হাতের জ্যোতি!

আয়াতটির একদম শেষে আল্লাহ্‌ আজওয়াজাল সতর্ক করছেন, “wa laa yakoonoo kallazeena ootul Kitaaba min qablu fataala 'alaihimul amadu faqasat quloobuhum wa kaseerum minhum faasiqoon” অর্থাৎ “তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী”। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ এই মহামূল্যবান কিতাবটি আমাদেরকে দেয়ার আগে যুগেযুগে আরও অনেক জাতিকে আল্লাহ’তাআলা কিতাব দিয়েছিলেনঃ তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর, এবং বিভিন্ন সহিফা। সময়ের পরিক্রমায় সেই সব জাতি তাদের নবী-রাসুলের উপর অবতীর্ণ কিতাবের শিক্ষাকে কখনো সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে, বা ভুলে গিয়েছে, অথবা বিকৃত করেছে, কিংবা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। তাদের কিতাব যেভাবে পড়লে, মেনে চললে অন্তর এবং কর্মে নূর লাভ করা কথা, পূর্বের সেইসব ব্যক্তিরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ইবলিশ সাফল্যের সাথে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পেরেছিল। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্‌র বিধানকে অস্বীকার করে তাদের হৃদয় এই নূর ধারণে অক্ষম হয়। বিচার বুদ্ধি ও বিবেক (spiritual insight) হারিয়ে ফেলে আধ্যাত্মিক দিক থেকে অন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম হয়। একসময় নূর ধারণে অক্ষম অন্তর হয়ে যায় কঠিন। ফলে তাদের চোখ থাকতেও তারা দৃষ্টিহীন অর্থাৎ তাদের হৃদয় অন্তর্দৃষ্টি বিহীন , কান থাকতেও তারা বধির, কারণ তারা কখনও সত্যের ডাক শুনতে পাবে না, ফলে তারা হবে বিবেক বর্জিত, ফলাফলস্বরূপ তাদের অধিকাংশই পাপাচারী। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন মুসলিম জাতিকে সেইসকল পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মত ভুল না করার জন্য, সেই দুঃখজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য সতর্ক করেছেন। কুরআন না বুঝে মুখস্ত করার জন্য আমাদেরকে দেয়া হয় নি। কুরআন পড়ে যদি বুঝতেই না পারি, তাহলে কীভাবে আমাদের অন্তরে এর বানী প্রবেশ করবে? দীর্ঘদিন আল্লাহ্‌র স্মরণ ও কুরআনের সংশ্রব থেকে দূরে থাকলে একসময় আমাদের অন্তর কঠিন হয়ে যাবে। শুধু আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠানের (বিয়ে, জানাজা, দাফন, মিলাদ ইত্যাদি) জন্য, দেয়ালে-যানবাহনে ঝুলিয়ে রাখার জন্য কুরআনকে দেয়া হয় নি। মৃত ব্যক্তির মাথার কাছে কুরআন খতম দিলে কোন লাভ হবে না, বরং জীবিত অবস্থায় সেই ব্যক্তি যদি কুরআন পড়ে কাজে লাগিয়ে থাকে তাহলেই সে নূরপ্রাপ্ত হবে। আকিকা করে আরবি নাম রাখলে আর মুসলমানি করলেই মুসলিম হয়ে যায় না, ঈমান অর্জন করতে হয়।

এই কয়েকটি আয়াতের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসীদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা চিত্রিত করা হয়েছে। আজকে আমি-আপনি যে ঈমানকে ধারন করি, সেটা ধ্রুব না। ফিতরাতের উপর জন্মানো প্রতিটি বিশ্বাসীর অন্তরে যে জ্যোতি থাকে সেটা আজীবন থাকবে এমন কোন গ্যারান্টি নাই। আজকে আমার ঈমান আছে বলেই আমি নিরাপদ, সেটা ভাবারও কোন অবকাশ নেই। একটু অসতর্ক হলেই ধাপে ধাপে ঈমান হারানোর সম্ভবনা আছে। আমরা অনেকেই নিজেদেরকে খুব ঈমানদার, মুমিন মুসলিম ভেবে আত্মতৃপ্তিবোধ করছি, ভাবছি “আমার জন্য জান্নাত নিশ্চিত”! অথচ দেখা যাবে, শেষ বিচারের দিনে জেগে উঠে কেউ কেউ আবিস্কার করবে তাদের নিজস্ব কোনই জ্যোতি নেই! অন্তরের এই নূর পাওয়ার জন্য আমাকে, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যমী হয়ে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ, সেই ভয়াবহ দিনে কেউ কাউকে ‘আলো’ দিয়ে সাহায্য করবে না, আপনার ঈমান আমার কোন উপকারে আসবে না, আমার ঈমান আপনাকে কোন সাহায্য করবে না। যতক্ষণ আমরা জীবিত আছি, এই অতি স্বল্প সময়ে অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে সময় নষ্ট না করে বরং পরকালের জন্য মহামূল্যবান জ্যোতি সঞ্চয়ের চেষ্টা করি। আল্লাহ্‌ আজ’ওয়াজাল আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত করুক, যারা হৃদয়ে আলো সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ’তাআলা আমাদেরকে মুনাফেক –এ পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করুক। আমাদেরকে, আমাদের সন্তানসন্ততি এবং পরিবার-পরিজনকে নিফাক থেকে বাঁচিয়ে রাখুক, অন্তরকে কঠিন হওয়া থেকে রক্ষা করুক, আল্লাহ্‌র স্মরণে এবং কুরআনের বানীতে অন্তরকে আদ্র ও নমনীয় করে দিক। এবং শেষ বিচারের দিনে নিজস্ব জ্যোতি নিয়ে জেগে ওঠার তউফিক দান করুন। আমীন।

[ উস্তাদ নু’মান আলী খানের দেয়া খুৎবা “How We Lose Our Iman” এর বাংলা ভাবার্থ। যা কিছু কল্যাণকর তার সম্পূর্ণই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে, আর যা কিছু ভুল সেটি সম্পূর্ণ আমার। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমার সেই ভুলগুলো মার্জনা করুন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। আল্লাহ্‌তালা আমাদের সকলকে কুরআনের আয়াতসমূহ বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন এবং সঠিক মর্মার্থ বুঝে সেই ভাবে জীবনকে পরিচালিত করার মত হিকমাহ, সাহস ও ধৈর্য দিক।]

[To watch the video go to: youtube.com/watch?v=DNC3y9rJI9c]


Wednesday, 7 December 2016