১.
তখন ইংল্যান্ডে থাকি। দীর্ঘদিন বেকার। কুকুরের মতো এদিক-সেদিক ছুটতে ছুটতে যখন ক্লান্ত, ঠিক সে সময়টাতে একটা চাকরি পেয়ে গেলাম। ঘন্টায় ৬ পাউন্ড, কাজটাও সহজ। লুফে নিলাম। তবে সমস্যা ছিল— এর সাথে সরাসরি হারাম কিছু কাজ জড়িত ছিল (সেসময়টাতে ইসলামের ‘ই’-ও বুঝতাম না।) জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মের বোধটা প্রথমদিকে একটু জ্বালাতন করলেও যখন দেখলাম আমার আর উপায় নেই এ চাকরি ছাড়া তখন সবকিছু বেমালুম ভুলে হারামে জড়িয়ে গেলাম।
অল্প কিছুদিনেই মানিয়ে নিলাম, চামড়ায় সইয়ে নিলাম; খারাপ বা হারাম কিছুই তখন আর মনে হল না। আশেপাশে থাকা সবাই-ই করে, করছে; কেউ যখন একে খারাপ ভাবে না, তাহলে আর সমস্যা কী? অধিকাংশ বাঙ্গালির ছেলেরা সেখানে রেস্টুরেন্ট, সুপার শপ অথবা বারে চাকরি করছে অহরহ। মদ আর শুয়োরের লেনদেন অতি সহজ-স্বাভাবিক বিষয় সেখানে।
২.
ঈদের দিন আমাদের ছুটিছাটা থাকত না, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কেউ কেউ ঈদের নামাজ পড়ে (২-১জন) ক্লাসে যেতাম আবার কেউ কেউ রেস্টুরেন্টে থালা বাসন মাজার মতো মহৎ কাজে লেগে পড়তাম। তবে ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ারে ব্যাপারটা ১৮০ ডিগ্রী। ছুটি, অভার টাইম, সবাই মিলে হইহই করে খেতে যাওয়া, সারিসারি আলোক-উজ্জ্বল বাতি-ক্রিসমাস ট্রি, বক্সিং ডে, সিনেমা হলে নতুন মুভি; সবমিলিয়ে খুসি-হি-খুসি। এতসবের ভেতর থেকে ঠিক কখন যে আমার মনের ভেতর থেকে ঈদের চেতনা আর আনন্দটা বেমালুম গায়েব হয়ে সেখানে ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার স্থান পেয়ে গেল সেটা টেরও পেলাম না। কুফফারদের সাথে থাকার প্রভাবটা মানুষের মাঝে প্রবেশ করে খুব প্রচ্ছন্নভাবে। ধীরে ধীরে। মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না কখন তার মনের নিয়াহ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি কমপক্ষে এমন হালি-খানেক মানুষদের চিনি যারা সেসব দেশে গিয়ে দাড়ি কেটে নামাযটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন। চারপাশে শিরক আর বেহায়াপনা থাকবে আর তার প্রভাব আপনার উপর পড়বে না সেটা অসম্ভব। এ ব্যাপারে রাসুল (সা:) আতরওয়ালা সংক্রান্ত হাদিসটা আমরা মনে করে দেখতে পারি।
৩.
এবার আসি জামাতে সালাহর ব্যাপারে। এসব দেশে থাকা কোনো মানুষ আল্লাহর কসম খেয়ে কোনোদিন বলতে পারবে না জামাতে সালাহ আদায় করতে তাদের কখনো, কোনই সমস্যা হয় না। আপনি যখন কাজে কিংবা ক্লাসে থাকবেন তখন জামাতে সালাহ করতে পারবেন না, পারবেন না, পারবেন না। কক্ষনোই না। এখন সিদ্ধান্ত আপনার—দেশে থেকে আটারুটি গেলার সাথে সাথে মাসজিদে সালাহকে আপনি গুরুত্ব দেবেন নাকি বিদেশে গিয়ে বার্গার খাওয়ার লোভে মিস করবেন জামাতে সালাহটা। উল্লেখ্য, পুরুষের জন্য জামাতে সালাহ ওয়াজিব। এখন আপনি জেনে-বুঝে এমন জায়গায় কেন যাবেন যেখানে আপনি জামাতে সালাহ আদায় করতে পারবেন না? রুটির বদলে বার্গার খেতে? এই জীবনের উদ্দেশ্য? বিস্ময়কর!
৪.
থুতু উপর দিকে মারলে নিজের গায়েই এসে পড়ে। থুতুর তাতে কিছু এসে যায় না, এসে যায় না উপরে থাকা মানুষদেরও। লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হয় নিজেকেই। একজন বিশিষ্ট ফেবু ইসলামি চিন্তাবিদ(?) আমাদের সম্প্রতি আলোকিত করলেন এই বলে—“অধিকাংশ আলিমরা আজকাল নাকি ক্রিটিকালি থিংকিং করতে পারেন না।” মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার এসব দেশ কীভাবে ‘দারুল ইসলাম’ হয় সেটাও নাকি তিনি ঠিক ঠাওর করতে পারছেন না। ধরে নেই আমাকে একটা রাস্তা পার হতে হবে যাতে অনেকগুলো বোমা পোতা আছে, পাড়া দিলেই সব্বনাশ, বুম! আর আরেকটা পথ আছে যাতে অল্প কিছু বোম আছে, যেগুলো একটু চেষ্টা করলেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, পথটা পাড়ি দেওয়া সম্ভব দেখে-শুনে, আমরা কোনটা বেছে নেব? প্রশ্ন রইল?
আপনি দুবাইর উদাহরণ দিলেন, মালেশিয়ার উদাহরণ দিলেন কিন্তু সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশ বা সৌদি আরবের মতো দেশগুলো, যেগুলোতে একটু চেষ্টা করলেই আপনি বহু ফিতনা এড়িয়ে চলতে পারবেন। ১০০ ভাগ ইসলামি না হোক আলিমদের সান্নিধ্যে থেকে অন্ত:ত ডজনখানেক মুসলিম ভাইদের সাথে উঠবস তো আমরা করতে পারি। রাসুল (সা:) মুসলিমদের ভেড়ার পালের সাথে তুলনা করেছেন, যারা একত্রে থাকলে বিপদে পড়ে না কিন্তু একা হলেই শেয়ালের আক্রমণের শিকার হয়। তেমনি মুসলিমরাও জামাতবদ্ধ থাকলে শয়তানের প্ররোচনা এড়িয়ে চলতে পারে। ভালো থাকতে পারে।
আমাদের আলিমরা যারা এ ব্যাপারে ফতওয়া দিয়েছেন তাঁরা যে কতটা প্রজ্ঞা আর গভীর জীবনবোধ থেকে ফতওয়া দিয়েছেন সেটা আমরা যারা দীর্ঘদিন এসব দেশে থেকে এসেছি তারা খুব খু-উ-ব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারি। পরিশেষে একটা হাদিস জানাই-
যখন “আব্বাস (রা:), নওফিল এবং আকিলকে বন্দি করা হয় রাসুল (সা:) তখন আব্বাস (রা:) কে বলেন—‘আপনি নিজের এবং আপনার দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের মুক্তিপণ আদায় করুন।‘ আব্বাস (রা:) বলেন—আমরা কি আপনার কিবলার দিকে নামায পড়তাম না? আমরা কি কালেমায়- শাহাদাহ পাঠ করতাম না? রাসুল (সা:) জবাব দেন। আপনার তর্ক তো উপস্থাপন করলেন কিন্তু আপনারা পরাজিত হবেন। শুনুন আল্লাহ তা’আলা বলেন—'আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না?' [সুরা-নিসা:৪]“ [হাদিসটি তাফসির ইবন কাসিরে পাওয়া যাবে]
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে একজন সাহাবী হিজরত করেননি, ধরা পড়লেন মুসলিমদের হাতে। এরপর তার সাথে কিরুপ আচরণ করা হল। অন্য হাদিসে রাসুল (সা:) বলেন—
“যে ব্যক্তি মুশরিকের সাথে মিলিত হয় এবং তার সাথে বসবাস করে সে তার মতোই।“
৫.
আমাদের বোঝা উচিত—রেসিসম এর কারণে যেসব মুসলিমরা কুফফার দেশে প্রায়শ:ই মারা যাচ্ছে আল্লাহ মাফ করুন তাদের এমনটা বলা হলে কী উপায় হবে?—
"যারা নিজের অনিষ্ট করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলে—আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।" [৪:৪]
বিস্তারিত জানতে তাফসির ইবন কাসির দেখা যেতে পারে। অবশ্য বিশিষ্ট ফেবু চিন্তাবিদ তাফসির ইবন কাসির পুরানো হয়ে গেছে সেটাও বাদ! বাদ! বলে চেঁচাবেন কি না তাও বিতর্কের বিষয়। একারণেই প্রায়শ:ই চৌকশ কবিরা বলে থাকেন—
“যার যার বুঝ, তার তার তরমুজ।”
শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬
প্রসঙ্গত ২টি লেখাঃ