রামাদানে বা হজ্জের সময় ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় কেন সালাতে মনোযোগ দিতে কষ্ট হয় কিংবা কেন আমাদের ঈমান দুর্বল থাকে তা ভেবে আপনি কি কখনো বিষ্মিত হয়েছেন? এর কারণ হতে পারে, সচরাচর আমরা সাধারণত একটি ফোনালাপের পরপরই তাকবীরে চলে যাই কিংবা অন্য আর সবার মতোই আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হই, যা আমাদের প্রকৃত অনুভূতি নয়।
আমাদের অনেকেই খুব সাধারণ জীবন যাপন করি, আর অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে আসন্ন কোন ঘটনার উপর, উদাহরণস্বরূপঃ ‘রামাদান শুরু হলেই আমি প্রতিদিন এক পাতা কুর’আন তিলাওয়াত করবো; হজ্জ থেকে ফিরেই আমি প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করবো; আমার সন্তান জন্মলাভ করলেই আমি ধুমপান ছেড়ে দিব।’ আর এ ধরনের চিন্তাভাবনার কারণেই সাধারণত আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা ধুমপান ছাড়তে পারি না, নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারি না, আর কুর’আন তিলাওয়াত শুরু করলেও কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর আমরা আবার আমাদের আগের অবস্থায় ফিরে যাই। কারণ, আমাদের এই ‘সংকল্প’ কিংবা ‘অনুভূতিগুলো’ আবেগ কিংবা ঝোঁকের কারণে সৃষ্ট; প্রকৃত চিন্তাভাবনার ফসল নয়। সাধারণত রামাদান কিংবা হজ্জের জন্য আমাদের কোন প্রস্তুতি থাকে না, যা আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করতে পারে; অন্য সবাই যা করে আমরাও তা করি এবং আশা করি আমাদের ঈমান বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু ঘটে না।
আপনি কি চান না আপনার রামাদান শুরু হোক অত্যন্ত ভালোভাবে এবং রামাদানের এই সুন্দর প্রভাব স্থায়ীভাবে বিরাজ করুক আপনার জীবনে? তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? আসুন জেনে নেই…এখানে ৮ টি ধাপ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো যা রামাদানের একটি স্থায়ী ফলাফল পেতে ইনশা আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবে..
১) একটি রমাদান ‘কাউন্ট ডাউন’ তৈরি করুনঃ রামাদানের দিন গণনা (মনে মনে কিংবা ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে) আপনার মনে এবং আপনার চারপাশে থাকা মানুষদের মাঝে সৃষ্টি করবে এক উম্মাদনা এবং গুঞ্জন। যখন আপনি এবং আপনার বন্ধুরা একই কর্মসূচীর জন্য দিন গুণতে থাকবেন তখন তা আপনাদের প্রতিদিনকার কথাবার্তা ও আনন্দ ভাগাভাগির অংশে পরিণত হবে।
২) রামাদান সম্পর্কে জ্ঞান অন্বেষণ করুনঃ এটা আপনাকে রামাদানের ইবাদাতসমূহ সঠিক ও পূর্ণভাবে পালনের নিশ্চয়তা দিবে এবং আপনার মাঝে রামাদানের অনুপ্রেরণামূলক দিক ও কাজগুলো সম্পর্কে এক উম্মাদনার সৃষ্টি করবে। রামাদান সম্পর্কে আপনি যতো বেশি জানবেন ততো বেশি ইবাদাত করে আপনার প্রতিদানকে বহুগুণে বাড়িয়ে নিতে পারবেন।
৩) রামাদানের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুনঃ হতে পারে এটা সম্পূর্ণ কুর’আন খতম দেয়া, নিয়মিত তারাওয়ীর সালাত আদায় করা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের ইফতারে আমন্ত্রণ করা; প্রথমে এই রামাদানে আপনি কোন ইবাদাতগুলো করতে চান তার একটি তালিকা তৈরি করুন, তারপর পরিকল্পনা করুন সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনার পরিকল্পনাগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং সেগুলো যাতে আপনার স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় কোন ব্যাঘাত না ঘটায় (উদাহরণস্বরূপ, এমন কোন পরিকল্পনা না করা যাতে আপনাকে পুরো এক মাস ছুটি নিতে হয় কিংবা কাজের সময় পরিবর্তন করতে হয়), তাহলে রামাদানের পরেও আপনি এই ইবাদাতগুলো চালিয়ে যেতে পারবেন ইনশা আল্লাহ। এই রামাদানে আপনি কী অর্জন করতে চান তা জানা থাকলে লক্ষ্য পূরণের ব্যাপারে আপনি অবিচল থাকতে পারবেন। রামাদানে প্রতিদিন রাতে পরবর্তী দিনের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করুন (চেষ্টা করুন রামাদানের পরেও এই অভ্যাসটি চালিয়ে যেতে)।
৪) নিজের জীবন সম্পর্কে সচেতন হোনঃ রামাদানে কিংবা রামাদানের পরপরই ঘটতে পারে এমন কোন বিষয়ের ব্যাপারে সচেতন হোন। রামাদানের মধ্যে কি আপনার পরীক্ষা আছে? কিংবা রামাদানের পরপরই কোন বিয়ের অনুষ্ঠান? অথবা বাসা বদলানো? যদি এ ধরনের কোন কর্মসূচী থেকে থাকে তবে এখন থেকেই সেগুলোর ব্যাপারে পরিকল্পনা করুন। এখন থেকেই পড়তে থাকুন, তাহলে রামাদান শুরুর আগেই আপনার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। সবকিছু গুছিয়ে নিন এবং রামাদান শুরুর আগে কিংবা পরে বাসা বদলানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করুন, যাতে তা আপনার ইবাদাতের সময় কেড়ে না নেয়। সর্বশেষ আপনার যে কাজটি করার সম্ভাবনা আছে তা হলো রামাদানে শপিং সেন্টারে ঘুরে সময় অপচয় করা। তাই ঈদ কিংবা বিয়ের কেনাকাটা রামাদানের আগেই সেরে ফেলুন।
৫) আধ্যাত্মিকভাবে তৈরি হোনঃ আমরা সবাই জানি রামাদান হচ্ছে সিয়াম পালন, সালাত আদায়, কুর’আন তিলাওয়াত এবং সাদাকাহ (দান) করার মাস। রামাদানের ঠিক প্রথম দিনটির জন্য বসে না থেকে এখন থেকেই এই ইবাদাতগুলো করা শুরু করুন। এখন থেকেই নফল সালাত, কুর’আন তিলাওয়াত, মানুষের প্রতি উদারতা প্রদর্শন প্রভৃতি ইবাদাতসহ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ সমূহ অনুসরণ করার চেষ্টা করুন। আর শাবান মাসে নফল সিয়াম পালনের কথা ভুলবেন না কিন্তু।
৬) আপনার মনকে প্রস্তুত করুনঃ সাওম হচ্ছে আমরা আমাদের মুখের মাধ্যমে যা কিছু গ্রহণ বা বর্জন করি তা থেকে বিরত থাকা। এখন থেকেই সংযমের চেষ্টা করুন, বিশেষ করে আপনার কথোপকথনের ব্যাপারে। পরনিন্দা, পরচর্চা কিংবা সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাকুন।
৭) বদ অভ্যাসগুলোকে বলুন ‘শুভ বিদায়’: নিজের বদ অভ্যাসগুলো চিহ্নিত করুন এবং রামাদানের জন্য বসে না থেকে এখন থেকেই সেগুলো ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। আপনার যদি দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে, তবে এখন থেকেই তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করুন; আপনি যদি ফেসবুক আসক্ত হোন তবে এখন থেকেই ফেসবুক কম ব্যবহার করার চেষ্টা করুন; কফির প্রতি খুব দুর্বল? তবে এখন থেকেই তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। আমরা সবাই জানি কোন কিছু বলা খুব সহজ কিন্তু করা কঠিন। তবে আপনি যদি একবার শুরু করেন এবং আপনার নিয়্যাহ যদি বিশুদ্ধ থাকে তবে দু’আর মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক সহজেই আপনার বদ অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিতে পারবেন।
৮) নিজের জীবনকে ইবাদাতের উপযোগী করে পরিকল্পনা করুনঃ সলাতের সময় কাজ কিংবা মিটিংয়ের আয়োজন না করে অন্য সময় করুন, যাতে সলাতের জন্য আপনার কিছু সময় বিরতি থাকে। আপনি যেখানে সলাত আদায় করেন সেখানে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং দুনিয়ার কথা ভুলে যান, কারণ সলাতের মাধ্যমে আপনি আল্লাহর সামনে দাঁড়াচ্ছেন।
আশা করি এই ৮ টি ধাপ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আপনারা সকলেই রামাদানে সামান্য হলেও উপকৃত হবেন। আর এর বাইরেও যদি আপনাদের কোন ব্যক্তিগত পরিকল্পনা থাকে তবে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। জাযাক আল্লাহ খাইরান।
[মূল লেখকঃ ওয়েসাম কেরায়েম, প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডট কম]