বিশাল একটা স্টেশন, এখানে অজস্র মানুষের যাতায়াত প্রতিদিন। ট্রেনের হুইসেল বাজছে, মালপত্র মাথায় নিতে জনে-জনে গিয়ে চিৎকার করে অনুরোধ করছে কুলিরা, প্রিয়জনদের পেয়ে কেউ চিৎকার করে ডাকছে, কারো চোখে অশ্রু – কাছের মানুষদের মিলনে অথবা বিরহে।
মাহফুজ চুপচাপ বসে আছে ওয়েইটিং রুমের কোনার একটা চেয়ারে। এইখানে এত শত-শত মানুষ — তাদের কেউ-ই তার আপন নয়, কাউকে চেনেনা। এখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও এক গ্লাস পানি কেউ দিবেনা — একথা ভাবতেই কেমন অস্থির হয়ে উঠলো তার মনটা। তার প্রিয়জনদের কথা ভাবতেই এমন লাগছে। অনেকদিন ধরে আজকের দিনটার জন্য অপেক্ষায় ছিল মাহফুজ। রুমের পড়ার টেবিলের উপরে রাখা ডেস্ক ক্যালেন্ডারটাতে দিন কেটে দিতে সে একটা লাল সাইনপেন কিনেছিল, লাল রঙ দিয়ে দাগ দিলে তাতে রাগ বেশি ঝাড়া যায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে সে যত্ন করে কেটেছে একেকটা দিন। আজ সকালে ইস্ত্রি করা শার্টটা বের করে পরেছে, অডিকোলন গায়ে দিয়েছে, দিনের পরিশ্রমে যেন তার ছিমছাম পরিপাটি ভাবখানা ছুটে না যায় সেজন্য তার চেষ্টার কমতি নেই। অফিস থেকে বসকে বলে আগেই বেরিয়ে এসেছে, অনেকদিনের এই অপেক্ষার কথা অফিসের কলিগরা আগেই জানত, তারা সবাই মুচকি হেসে বিদায় দিলো দুপুরে লাঞ্চের পরেই।
ওয়েইটিং-রুমে বসে থেকে মাহফুজের কান সজাগ, নতুন কোনো ঘোষণা কিনা, হুইসেল শোনা যায় কিনা নতুন ট্রেন আগমনের। কোন ট্রেন এলেই খোঁজ করছে এটা ‘অরণ্য নীলিম’ কিনা। যাদের অপেক্ষায় এখানে এসেছে সে, তাদের কারো সাথে আবার ফোন নেই, তাই যোগাযোগ করতে পারছেনা। কেবল অপেক্ষার প্রহর গুণে চলেছে, এই বুঝি এলো! কিন্তু অমন অনেকগুলো ট্রেন এলেও তারটার দেখা নেই…
পাশের চেয়ারে পড়ে থাকা জীর্ণ পুরনো পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় সে – নাহ! মন বসছে না কিছুতেই। উশখুশ করছে মাহফুজ। অনেকদিন পর আসবে সে, তাই ঘরদোর নিজের হাতে পরিষ্কার করেছে সে ক’দিন ধরে। নতুন জানালা-দরজার পর্দা লাগিয়েছে, বিছানার চাদর কিনেছে সাদার ভেতর উজ্বল নীল রঙ্গা ফুলে ছাপানো। এই কন্ট্রান্সটটা তাসনীয়ার অনেক পছন্দ!
হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সন্ধ্যা প্রায়। দিন প্রায় পুরোটাই চলে গেল। স্টেশন মাস্টারের রুমে উকি ঝুকি দিল সে- চেয়ারটা ফাঁকা দেখে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো। এইসবের কোনো মানে হয়? একটা কোনো এনাউন্সমেন্ট পর্যন্ত নেই। প্ল্যাটফর্মে ইতস্তত পায়চারী করতে থাকে সে। স্টেশন মাস্টারের রুমের বাইরের আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিলো সে। যেন পরিপাটি লাগে তাই গেল হপ্তায় শুক্রবার দিন চুল কাটিয়েছে। তাছাড়া একা থাকার সময়টায় সপ্তাহের ছুটির দিনেই অনেক কাজ পড়ে যায় তার –একা একা কাপড় ধোয়া, রান্নাঘরের সিঙ্কে জমানো গাদা গাদা বাসন কোসন ধোয়া এমনি আরো কত কী! আরেকজন তার এইসব কষ্টটুকুর জন্য কতইনা মন খারাপ করে ভেবে ভালোবাসায় মুখটা রক্তিম হয়ে এলো মাহফুজের। হঠাৎ মুখে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে তার। পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজ ছুঁলো সে একটা — তালিকা লিখেছে কাজ ভাগাভাগির। এইটা নিয়ে দু’জনের ঢিশুম ঢিশুম ফাইট হবে সে জানে। তাইতো যত্ন করে লিখে রেখেছে। এতদিন পর দেখা হবে, একটু খুনসুঁটি না হলে হয়? লাজুক হাসিতে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে মাহফুজ।
মাগরিবের ওয়াক্ত প্রায় হয়ে এলো। গোধূলির আলোতে প্ল্যাটফর্মে একটা ধোঁয়াটে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখনো আলো জ্বালানো হয়নি সবগুলো। হঠাৎ দূরে ট্রেনের হুইসেলের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় মাহফুজ। বুকের স্পন্দন টের পাচ্ছে সে — ধুকধুক ধুকধুক। আনন্দ, উত্তেজনা আর ভালোবাসার স্পন্দন বুঝি এমনই হয়। এত অপেক্ষার পর যদি প্রিয়জনটি নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে, সুস্থ শরীর আর মনের পরিচয় প্রকাশক একটা হাসি দেয় — সেই আনন্দ, সেই উদ্বেলিত হৃদয়ের অনুভূতি কি কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায়? যারা অমন অপেক্ষা করেনি কোনদিন, তারা কীভাবে বুঝবে অপেক্ষার পরে প্রিয়জনদের কাছে পাওয়ার ভালোবাসা কত তীব্র থাকে, তাতে কত গভীরতা থাকে, সেই হৃদয়ে কত আকুতি থাকে…
অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ‘চ’ বগির দরজায় চোখ লাগিয়ে রাখে মাহফুজ। সাদা-নীল স্কার্ফ পরা চিরচেনা মানবীর অবয়ব দেখে যেন আবেগ উথলে উঠে মাহফুজের। তার অপেক্ষার পালা বোধহয় শেষ হল। এক মাস হলো তাসনীয়া গিয়েছিলো মা’র বাড়ি। তার কাছে যেন মনে হচ্ছিলো এক যুগ দেখেনি সে মেয়েটির গভীর মমতামাখা চোখদুটো, দুষ্টুমি ভরা হাসি, শোনা হয়নি অফিস থেকে ফিরে বাসার দরজা খুলেই ভালোবাসামাখা কন্ঠের জিজ্ঞাসা — “আসসালামু আলাইকুম! আজ শরীর মন ভালো তো স্যার?”