মাঝে মধ্যেই পুরোনো এক বন্ধু ফোন করে। কুশলাদি জানতে চায় উষ্ণ কন্ঠে। সেদিন দুপুরের দিকে ফোনে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। কন্ঠটা একটু ভার ভার মনে হল। বুঝলাম মন খারাপ। কি হয়েছে জানতে চাইলাম।
বন্ধু যা বলল তার সারমর্ম হল – তার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই (ছেলে মেয়ে। বন্ধু আমার ততোটা প্র্যাক্টিসিং না) কমবেশি ভালবাসার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারিতে হাত সাফাই, পার্কে “বাদাম খাওয়” বা রিকশায় “বাতাস ” খাওয়া এসব ওরা নিয়মিতই করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ভালবাসার সম্পর্ককে চাঙ্গা করতে কেউ কেউ হয়তো লিটনের ফ্ল্যাট থেকেও ঘুরে আসে। এরকম অস্থির পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও বন্ধুর গায়ে অশ্লীলতার বাতাস সেরকম লাগেনি। এরকম পরিবেশে সে কতদিন ভালো থাকতে পারবে সে জানে না। ভার্সিটি লাইফের একেবারে শেষে এসে তার পক্ষে ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে বের হয়ে যাওয়াও সম্ভব না; গ্রুপ স্টাডি করে একসঙ্গে। আমার কাছে জানতে চাইলো এখন সে কী করবে? চুপ করেই থাকলাম। কিই’বা বলার আছে আমার? এই দেশে এই সময় এই প্রশ্নের যে কোন উত্তর নেই।
বুকের একেবারে গভীর থেকে উঠে আসা বড় বড় দীর্ঘশ্বাস গুলোর আড়ালে সে চেষ্টা করছিল তার কষ্ট গুলো লুকিয়ে রাখার। কিন্তু পারলো কই? সে শুধু একা নয়, তারমতো অনেকেই চারপাশের সস্তা ভালোবাসার ছড়াছড়ির মাঝেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ চায়, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো একা একা লড়ে যায় এই হাইপার সেক্সুয়ালাইজড সমাজটার বিরুদ্ধে। তাদের পবিত্র থাকার আকুতিগুলো, হৃদয়ের আর্তনাদগুলো চারদেয়ালের মাঝেই থমকে যায়। ভোগবাদের জোয়ারে গা ভাসানো এই সমাজটার সময় নেই এই ছেলেগুলোর কষ্টগুলো বুঝতে চেষ্টা করার, আর্তনাদগুলো শোনার। কিন্তু পরম করুণাময় সাত আসমানের উপর থেকে নিশ্চয়ই দেখেন এই ছেলেগুলোর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। সিজদাতে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানো এই ছেলেগুলোর চোখের পানির প্রতিদান একদিন নিশ্চয়ই তিনি দিবেন। ইনশা আল্লাহ।
এই হৃদয়হীন সমাজটা এই ছেলেদের কষ্টগুলো না বুঝুক, আল্লাহ (সুবঃ) অবশ্যই বোঝেন এই ছেলেদের কষ্ট গুলো। এই ছেলেগুলো তাঁরই উপর ভরসা করে এবং তাঁর কাছেই প্রতিদান আশা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ’র (সুবঃ) ওপর ভরসা করে তাঁর জন্য তিনিই যথেষ্ট।
এক ভাইয়ের সঙ্গে একবার কথা হচ্ছিল ঈদের দিন কে কীভাবে মজা করে এইগুলো নিয়ে।আমাদের জেনারেশনের ছেলেমেয়ে কোন একটা উপলক্ষ পেলেই হয় – সেটাকে ভ্যালেন্টাইনডে বানিয়ে ফেলতে ভুল করে না। ভাই বলছিলেন – ঈদের বিকেলে রিকশায় জোড়ায় জোয়ায় কপোত কপোতী দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'তোমার মাঝে মাঝে খারাপ লাগে না, ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে না'?
আমি বলেছিলাম, 'হ্যাঁ ভাই। চারপাশের এইসব সস্তা ভালোবাসার ছড়াছড়ি দেখে ভেতরটা খাঁ খাঁ করে একজনের জন্য।
ভাইকে সেদিন বলা হয়নি এই একাকী থাকার জন্য আমার যতটা না খারাপ লাগে তারচেয়েও বেশি খারাপ লাগে আল্লাহর ঐসব অবুঝ বান্দার জন্য, যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে একটা হারাম রিলেশানে জড়িয়ে আছে, বিনোদনের নামে পর্নমুভি,আইটেমসং এই টাইপের জিনিসগুলো নিয়মিত দেখছে। ফেসবুকে নামীদামি রেস্তোরায় চেকইন, জানুপাই, বেবীপাই, কুট্টুস ক্যাপশনের কাপল সেলফি দেখে মনে হতে পারে এরা বোধহয় বেশ সুখেই আছে। শান্তিতে আছে। আসলে এদের মনে এতটুকুও শান্তি নেই। বাবা মার হাতে ফোনে কথা বলতে যেয়ে ধরা পড়ে যাবার টেনশন, বিএফ জিএফের সাথে নিয়মিত দেখা করার ঝামেলা, রেস্টুরেন্ট বিল, এই সেই হাবিজাবি নিয়ে এদের প্রচুর টেনশানে থাকতে হয়। আল্লাহ’র (সুবঃ) আইনকে অমান্য করার জন্য আল্লাহ এদের অন্তর অশান্ত করে দেন। আর বিয়ের পরে তাদের সংসারে শুরু হয় আরো অশান্তি।
এই সব অবুঝ ভাইবোনেরা যদি জানতো হারাম রিলেশান থেকে দূরে থাকা ভাইবোনদের অন্তর গুলো কতটা শান্ত! আল্লাহ কি পরিমান সকীনা ঢেলে দিয়েছেন সেই ভাইটির অন্তরে যিনি রাস্তায় চলাফেরা করার সময় শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে চোখের হেফাজত করেন! তারা যদি উপলব্ধি করতে পারতো সেই বোনটির অন্তরের প্রশান্তি যিনি শীতের গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে তাঁর রবের সিজদাতে যেয়ে দু’আ করেন – তার রব যেন তাকে এমন একজন জীবন সঙ্গী দান করেন যিনি তাঁর চোখ শীতল করবেন।
ফিতনায় ভরপুর এই যুগে নিজের নফসকে সংযত করা বড় কঠিন ভাই। আমরা বোধহয় সেই সময়ে চলে এসেছি যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণ করা হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে থাকার চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। চারপাশের সব কিছুই ভেতরের প্রবৃত্তির আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট। বিল বোর্ড, বিজ্ঞাপন, নাটক, সিরিয়াল, মুভি, পত্রিকা সব কিছুতেই নগ্নতা আর বেহায়াপনার বিচরণ। শয়তান তার সকল হাতিয়ার ব্যবহার করে আমাদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে এবং তাতে সে সফলও। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই তার ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই বলে তুমি,আমিও কি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যাব?
ভাই, হারাম রিলেশান জিনিসটা শয়তান আমাদের কাছে শেয়ারিং, কেয়ারিং, রোমান্টিসজমের প্যাকেজ বানিয়ে অনেক আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করে। বিয়েকে কঠিন করে ফেলা এবং ব্যাভিচারকে সহজলভ্য করে ফেলা এই সমাজে শয়তানের এই প্যাকেজ ফিরিয়ে দেওয়া অনেক অনেক কষ্টকর। সিরিয়াল, পর্নমুভি,আইটেম সং এর বিনোদন থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখাও তো অনেক কষ্টকর। কিন্তু তোমার আমার এই কষ্ট কী বিলাল ইবনে রাবাহ (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হোক) এর কষ্টের চেয়েও বেশি যাকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে খালি গায়ে শুইয়ে রেখে তাঁর ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো? তোমার আমার এই কষ্ট কী মুসআব ইবনে উমাইর (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হোক) চেয়েও বেশি যিনি মক্কার সবচেয়ে ড্যাম স্মার্ট, সুদর্শন, ধনী আদরের দুলাল ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল। পেছনে ফেলে আসতে হয়েছিল বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্টিতে তার গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিল যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে। সাহাবীগন (রাঃ) জীর্ণ পোশাকের মুস’আবকে (রাঃ) দেখে চোখের পানি আটকাতে পারতেননা। ভাই তাঁরাও তো আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তাঁরা যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সাঃ) এর জন্য এতোটা কষ্ট করতে পারেন, ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তাহলে আমরা কেন এতটুকু কষ্ট করতে পারবো না? আমরা কি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি না? না কি শুধু মুখেই দাবি করি?
ভাই, তুমি আমি কি চাই না জান্নাতের স্ত্রীকে নিয়ে খালিপায়ে সবুজ ঘাসের চাদরে হেঁটে বেড়াতে, অলস দুপরে নারিকেল বীথিতে বসে সমুদ্রের ঐ নীল জলরাশির দিকে চেয়ে থাকতে? তোমার কাঁধে তোমার প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ জান্নাতী স্ত্রী মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে, মাতাল বাতাসে তোমার জান্নাতী স্ত্রীর চুল এলোমেলো হয়ে তোমার চোখ মুখে এসে পড়ছে, প্রাণভরে নিচ্ছো তুমি তাঁর চুলের সুবাস। যতবার তোমার স্ত্রী হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে যাচ্ছে, ততবার তাঁকে আগের বারের চেয়ে বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে, তাঁর মুখটার দিকে তাকিয়ে তুমি নতুন করে তাঁর প্রেমে পড়ে যাচ্ছ ততবার।
এইগুলো কি এমনি এমনি পেয়ে যাব তুমি, আমি? এর জন্য কষ্ট করতে হবে না? ভালো জিনিস কি কেউ এমনি এমনি দেয়? জান্নাতের স্ত্রীদের জন্য মোহরানার ব্যবস্থা করতে হবে না?
“……তোমরা কি মনে করে নিয়েছ তোমরা এমনি এমনি বেহেশতে চলে যাবে?
অথচ পূর্ববর্তী নবীদের অনূসারীদের মতো কিছুই তোমাদের উপর এখনো নাযিল হয়নি। তাদের উপর বহু ধরণের বিপর্যয় ও সংকট এসেছে, কঠোর নির্যাতনে তারা নির্যাতিত হয়েছে, কঠিন নিপীড়িত তারা শিহরিত হয়ে উঠেছেন, এমন কি স্বয়ং আল্লাহ্র নবী ও তার সঙ্গী সাথীরা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে এই বলে আর্তনাদ করে উঠেছে, আল্লাহ্র সাহায্য কবে আসবে? অবশ্যই আল্লাহ্র সাহায্য অতি নিকটে" [২:২১৪]
ভাই,আমাদের রব আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন এই দুনিয়াতে। যাতে তিনি আমাদের পবিত্র করতে পারেন আমাদের পাপ থেকে, হাশরের ময়দানে আমাদের স্থান দিতে পারেন তাঁর আরশের ছায়ায়, কাউসার থেকে পানি পান করাতে পারেন, তাঁর দীদার দিয়ে আমাদের মানব জন্ম সার্থক করতে পারেন। তাই ভাই, দুনিয়ার এই ফিতনা, এই পরীক্ষায় হিম্মত হারিয়ে ফেললে হবে না। আল্লাহ্র ওপর তাওয়াক্কুল করে, তাঁর নিকটে অনবরত সাহায্য চেয়ে আমাদের কোমরবেঁধে লাগতে হবে এই পরীক্ষা উৎরানোর জন্য। আমাদের মঞ্জিল ভাই এই বয়ফ্রেন্ড, গার্ল ফ্রেন্ডের দুদিনের রিলেশান না, জিনা, ব্যভিচারের সাময়িক ফুর্তি না, আমাদের মঞ্জিল জান্নাত। জান্নাতে এক মুহূর্ত কাটানোর পর ভাই তুমি ভুলে যাবে দুনিয়ার এখনকার এই দুঃখ, কষ্ট গুলো।
চলোনা এই জীবনের এই সাময়িক দুঃখ, কষ্ট গুলো সিজদাতে লুটিয়ে পড়ে চোখের পানিতে সমর্পণ করি আমাদের রবের কাছে।
“ …….আমি তো আমার অসহনীয় যন্ত্রণা, আমার দুশ্চিন্তা আল্লাহ্র কাছেই নিবেদন করি” [১২:৮৬]