শিশুদের ডিভাইস আসক্তি বা ডিভাইস ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে বলতে গেলে আজকাল একটা কথাই বেশি শুনতে পাই -- ডিভাইস না দিলে নাকি এখনকার বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার উপায় নেই।
আমার বাসায় টিভি নেই। বাচ্চাদের ডিভাইস দেখতে অভ্যস্ত হতে দেইনি বহু আগে থেকেই। গত বছর সপ্তাহে শুধু একদিন নির্দিষ্ট সময়ে দিতাম। ইউটিউবে সিলেক্টেড কিছু ভিডিও দেখতো। এবার কয়েক মাসে একবার কী দুইবার দেয়া হয়। কখনো আমি নিজে কোন ইন্টেরেস্টিং ভিডিও দেখলে ওদের ডেকে দেখাই; মাঝে মাঝে দেশের খবর, আন্তর্জাতিক খবর ইত্যাদি সাথে নিয়ে দেখি; কখনো তিলাওয়াত শুনতে দেই। আলহামদুলিল্লাহ্ গেইমস অথবা কার্টুনের প্রতি ওদের সামান্যতম আসক্তি নেই, যা এখনকার অধিকাংশ বাচ্চাদের মাঝে দেখা যায়। মিউজিকসহ ভিডিও ওরা সহ্য করতে পারে না। আমার চার বছরের ছোট ছেলেটা একটাও নার্সারি রাইমস বা শিশুতোষ ছড়া পারে না। বিখ্যাত ফেইরি টেলস আমি ইসলামাইজ করে শোনাই।
অনেকেই বলে পিঠাপিঠি তিন ছেলে হওয়াতে নাকি আমাকে ডিভাইস দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না, একজন সন্তান হলে বুঝতাম -- নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য তখন নাকি একটু আধটু কার্টুন দেয়াই লাগতো।
বাচ্চারা সারাক্ষণ যে তিনজন একসাথে থাকে তা না। ওরাও আর দশটা শহুরে বাচ্চার মতো কংক্রিটের জালে বন্দি। খুব বেশি খেলনাও কিনে দেয়া হয় না। তবে সময় কাটানোর জন্য ওরা নিজেরাই বিভিন্ন পন্থা বের করে ফেলে।
বড় ছেলেটা বইয়ের পোকা। দিন-রাত বই নিয়ে থাকে। টিনটিনের কমিক্স থেকে শুরু করে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম) সীরাত -- কোনটাই বাদ যায় না। মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর একা একাই ফুটবল খেলে নয়তো বসে বসে পেইন্টিং অথবা ক্রাফটিং করে। আর বাকি দুইজন একসাথে খেলে বেশির ভাগ সময়। মজার মজার খেলা নিজেরাই আবিষ্কার করে ফেলে। একা থাকলেও দেখেছি সময় কাটানোর অভিনব কোন বিকল্প খুঁজে নেয়।
যেমন, গতকাল জ্বর থাকার কারণে আজ সকালে স্কুলে যায়নি আমার ছয় বছুড়ে মেজো ছেলেটা। সারা সকাল একা একা খেলেছে সে। কাছে গিয়ে দেখি ছোটখাটো যা কিছু পেয়েছে তা দিয়ে খেলছে -- মাসজিদে জুম্মার সলাতের খুতবাহ শুনছে সবাই। খতিবসাহেব (কাঠি দিয়ে বানানো প্লেইন) খুতবাহ দিচ্ছেন, খুতবাহর বিষয় কোন এক নবীর (আলাইহিসালাম) কাহিনী। ও পাশে বসে নবীদের কাহিনী বই থেকে গড় গড় করে পড়ে যাচ্ছে। একটু পর দেখি ইমাম সবাইকে বলছে “কাতার সোজা করেন”। এরপর সলাত শুরু হলো। প্রথম রাকাতে সুরাহ ফাতিহার পর সুরাহ মারিয়ামের প্রথম রুকু, দ্বিতীয় রাকাতে সুরাহ নাবা পড়া হলো। আলহামদুলিল্লাহ্ সুরাহগুলো সুর করে ও নিজেই পড়ে শোনালো।
যে কোন বাচ্চাকে একা কিছু খেলার উপকরণ দিয়ে ছেড়ে দিলে সে নিজেই মজার কিছু করার খুঁজে নেবে। খেলনা দিয়ে খেলতে ইচ্ছা না করলে পুরনো বোতল, জুতার বাক্স, খবরের কাগজ বা যে কোন কিছুকে সে খেলনা বানিয়ে নেবে। অহেতুক নার্সারি রাইমস দিয়ে মাথা বোঝাই না করে তাকে ছোট ছোট সুরাহগুলো শেখাবেন, অর্থ নিয়ে আলোচনা করবেন। তাকে যতটুকু সময় দেয়া দরকার দিবেন। বাকি সময় বিপজ্জনক জিনিশগুলো হাতের নাগালের বাইরে রেখে তাকে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিবেন। নতুন কিছু করলে হাসিমুখে উৎসাহ দিবেন। তার ক্রিয়েটিভিটির প্রশংসা করবেন। নানান অযুহাতে ডিভাইস দিয়ে বসিয়ে রেখে তাকে ফার্মের মুরগি বানাবেন না প্লিজ!