ভার্সিটির হলে থাকার সময় খুব হিসেব করে টাকা খরচ করতাম। মাসের প্রথম দিকে হাজার তিনেক টাকা আসতো আমার কাছে, সেটাই পুরো মাসের সম্বল, কিন্তু দেখা যেত মাস শেষে সেখান থেকেও কিছু বেঁচে গেছে। আমার বন্ধুরা বলতো আমার উপর আল্লাহর রহমত আছে, সেজন্য আমার সবকিছুতে বরকত হয়।
টাকা বাঁচানোর জন্য হলে আমরা না খেয়ে থাকতাম এমন কিন্তু না। সকাল বিকেল নাস্তা, দুপুরে-রাতে ভাত সবই চলতো। খাবারের দাম কম তা ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের হিসেবি খরচে একটা ভিন্ন জীবন যাপন পদ্ধতি গড়ে উঠেছিলো। ছোট্ট এক টুকরো গরুর মাংস, ভাত, ডাল এসব মিলে ৪০ টাকা মত লাগতো। এটাই ছিলো আমাদের জন্য হল ডাইনিং এ সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ খাবার, যারা এটা খেতো তাদের পকেটের অবস্থা ভালো বলে আমরা ধরে নিতাম। নীলক্ষেত মামা হোটেলে আমরা মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। দুইজন মিলে যেতাম, মুরগির ঝাল ফ্রাই বলে একটা আইটেম পাওয়া যায় সেখানে, চার পিস মুরগির মাংস থাকতো, দুই জন মিলে খেতাম। বিল আসতো একশো টাকা, ফিফটি ফিফটি বিল দিতাম দুইজন মিলে। মাঝে মাঝে এরকম ভুরিভোজটাই ছিলো আমাদের জন্য বিশাল কিছু। হল থেকে শাহবাগ, নীলক্ষেত—রিকশায় উঠার কথা আমরা চিন্তাও করতাম না।
স্টুডেন্ট লাইফের শেষ দিকে আমি একটা চাকরী শুরু করি। মাস শেষে যে টাকা আসতো সেটা বর্তমান বাজারে আহামরি কিছু না, কিন্তু হলে যে জীবন যাপন পদ্ধতিতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম—সেখানে এই এমাউন্ট রীতিমত "এত টাকা দিয়ে করবো কী" টাইপ মনে হতো! এরপর আস্তে আস্তে জীবন যাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসা শুরু করলো। দেখা যেত প্রায় বাইরে খেতে যাচ্ছি, সকালের কলা-পাউরুটির জায়গায় এটা ওটা খাচ্ছি, বন্ধুদের ট্রিট দিচ্ছি, পাঁচ টাকা দামের চায়ের জায়গায় প্রতিদিনই পনেরো টাকায় কফি খাচ্ছি। শাহবাগ, পলাসী, নীলক্ষেত—রিকশা ছাড়া যাচ্ছি না। যে তিন হাজার টাকা থেকে মাসে কিছু বেঁচে যেত, সেখানে এখন মাসের খরচ ডাবল হয়ে গেলো। অথচ আমি আমি-ই আছি, এখনো হলেই আছি, শুধু একটি জীবন যাপন পদ্ধতি থেকে আরেকটি পদ্ধতিতে পদার্পণ আমাদের জীবনের চাকা অনেক সময় ঘুরে যায়।
অনেকের সাথে প্রায়ই আলোচনা হয় দ্বীন বনাম দুনিয়া নিয়ে। তারা প্রশ্ন করে ইসলাম কী আমাদেরকে দুনিয়া ছেড়ে দিতে বলে, আমরা কী দুনিয়ার কিছুই করবো না, সাহাবীরা তো এটা করেছেন, ওটা করেছেন। অনেক তর্ক হতো। কিন্তু এক কথায় বললে, সাহাবীরা দুনিয়া কামাই করেছেন সত্য, কিন্তু তারা কখনও জীবন যাপনের যে নববী পদ্ধতি সেটা পরিবর্তন করেননি। সেজন্য তাদের কামাইকৃত দুনিয়া তাদের দ্বীনের কোন ক্ষতি করতে পারেনি, সেই দুনিয়া তারা দুনিয়াতেই ছুড়ে মেরেছেন।
"আপনি বলুনঃ আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুনঃ এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে।" [সূরা আরাফঃ আয়াত ৩২]
আল্লাহ্ আরো বলেন,
"তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃতি, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।" [সূরা আল ইসরাঃ আয়াত ২৯]
এই আয়াতগুলো যখন নাজিল হয়, নবীজি (সাঃ)-এর স্ত্রীরা একদিন নবীজিকে ঘিরে ধরলো, তাদের ভরণ পোষণের খরচ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাঁরা মনে করলেন ইসলাম এবং মুসলিমরা যেহেতু এখন ভালো অবস্থায় আছে, ধন সম্পদ বাড়ছে, এখন আর আগের সেই জীবন যাপন পদ্ধতিতে কিছুটা ঢিলে দেওয়া যাবে। কিন্তু আল্লাহ বললেন,
“হে নাবী! আপনি আপনার সহধর্মিনীদের বলে দিন, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ ও এর বিলাসিতা কামনা কর, তাহলে এসো আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দেই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদায় করে দিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও পরকালকে কামনা কর তাহলে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণা আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [৩৩:২৮-২৯]
আল্লাহর নবী (সাঃ) ছিলেন উম্মতের জন্য আদর্শ, ঠিক তেমনি উম্মুল মুমিনীনরাও। তাঁরা যদি দুনিয়ার ভোগ বিলাসের জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করতেন তাহলে সেটা উম্মতের জন্য আদর্শ হিসেবে গড়ে উঠতো। তাই যদিও ইসলাম ভালো অবস্থায় ছিলো, কিন্তু আল্লাহর নবী, সাহাবীরা কখনোই তাদের সেই জীবন যাপন পদ্ধতিতে ঢিল দেননি। তাঁরা আখিরাতের জন্য বেঁচেছেন, ইসলামের খারাপ সময়েও, ইসলামের ভালো সময়েও।
আমাদের কারো জীবনই থেমে থাকে না। চার হাজার টাকা দিয়ে শার্ট কেনে কেউ, আবার দেড়শো টাকা দামের শার্ট কিনেও কেউ দিব্যি চলছে। কারো মাসের বাজার খরচ যায় অন্য কারো দুই তিন মাসের বেতনের সমান। কেউ রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজার খানেক বিল দিয়ে খায়, আর কেউ টং দোকানে চায়ে চুবিয়ে পাউরুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। মাস শেষে তাই দুই লাখ টাকা বেতন পাওয়া মানুষটার জীবনটাও কেটে যাচ্ছে, আবার মসজিদের মুয়াজ্জিন যার বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা, সেও বউ-বাচ্চা পরিবার নিয়ে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে।
বিয়ের সময়ও তাই পাত্র-পাত্রীর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস মেইন্টেইন করার ব্যাপারটাতে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আবেগের চেয়ে বাস্তবতা বেশি জরুরী। দেখা গেলো মেয়ে যে ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে সেখানে সে এক্সপেন্সিভ জীবন যাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত, কিন্তু ছেলের ফ্যামিলিতে এসে তাকে ভিন্ন এক জীবন যাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে পারছে না। জীবন যাত্রার মান উপরে উঠাতে হাজব্যান্ডকে চাপ দিচ্ছে, পাল্লা দিতে গিয়ে হাজব্যান্ড হিমশিম খাচ্ছে। একসময় এভাবেই অনেককেই দ্বীনের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে হয়। এভাবে অনেকেই ঝরে যায়...
বাবা-মায়েদেরও উচিত ছোট থেকে ছেলে-মেয়েদেরকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত না করা। ছোট বেলা থেকেই বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেই মান ধরে রাখতে গিয়ে অনেক সময় পরিবারের কর্তাকে নানান অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে হয়।
সবচেয়ে উত্তম জীবন পদ্ধতি হলো সুন্নাহ উপায়ে জীবন যাপন করা। সবচেয়ে সেফ সাইড। দুনিয়া আখিরাত সব দিকেই উন্নতি করা সম্ভব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমীন।