গতকাল রাত ১১টা ৩০ মিনিট। সন্ধ্যা থেকে ঝুমঝুম বৃষ্টি শেষে ওই সময়টায় আকাশের পানি একটু কমছে। এমন সময় আমাদের সদর দরজায় কে যেনো কড়া নাড়ছে। জানতে পারলাম পাড়ার এক বড় আপা আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। উনার মুখে শুনলাম আমাদের এলাকার বিহারী বুড়ি নামে পরিচিত একজন মহিলা সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে ইন্তেকাল করেছেন কিন্তু লোকের অভাবে এখন পর্যন্ত গোসল দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিবারের সদস্যরা রাতেই গোসল দিতে চাচ্ছেন, কোন ব্যবস্থা করা যাবে কিনা?

শহরের অনেক জায়গায় ইলেক্ট্রিসিটি নাই। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এত রাতে অটো রিকশাও পাওয়া যাবে না। কে আসবে এখন! তবুও বেশ কয়েক জায়গায় ফোন দিলাম। কিন্তু কেউই আসতে রাজী হলোনা। অবশেষে একজন আপা আসার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন। জানতে চাইলেন যেই মহিলা মারা গিয়েছে উনি সলাত আদায় করতেন কি না। আমরা হ্যাঁ সূচক জবাব দেওয়াতে উনি এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন। বললাম আপা এত রাতে কিভাবে আসবেন, আপনার বাসা তো প্রায় তিন কিলো দূরে। উনি বললেন, আমার বাসাতে বৃষ্টির পানি উঠছে । বাসার সামনের গলিতেও পানি, তবু আমি আমার স্বামীকে নিয়ে পায়ে হেটেই রওনা দিচ্ছি। আপনারা কাফনের কাপড় রেডি করেন আর বড় কড়াইয়ে বরই পাতা দিয়ে পানি গরম করার ব্যবস্থা করেন। আল্লাহু আকবার!

আমাদের বাসার পাশে পুলিশ লাইনের বাগান। সেখানে ইদানিং শিয়ালের খুব আমদানি বাড়ছে। তাই আমরা কয়েকজন বাশ হাতে নিয়ে পুলিশ লাইনের গেটে অপেক্ষা করা শুরু করলাম। এমন সময় একটা অটোরিকশাও পেয়ে গেলাম। আল্লাহ সহজ করে দিলেন। উনাদের কিছুটা পথ হাটার কষ্ট থেকে রক্ষা করতে অটো রিকাশ নিয়ে এগিয়ে গেলাম। দেখি রাস্তা পুরো জনমানব শুন্য। শুধু কালো বোরখা পড়া একজন মহিলা হেটে হেটে এগিয়ে চলেছেন। পিছন থেকে উনার স্বামী মাথায় ছাতা ধরে আছেন। হাতে টর্চ লাইট ও নাই। রাস্তার পোলে ইলেক্ট্রিক বাল্ব জ্বলছে না। উপরে আকাশে থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। ভীতিকর একটা পরিবেশ। কিন্তু তাদের মনে যেনো কোন ভয়ডর নাই।

অতঃপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে আপা মৃত বিহারী বুড়ির বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। আমাদের এলাকায় একটা নতুন বিদাত চালু হয়েছে। বিচি গনা। মৃতের পাশে বসে মহিলারা কি যেনো দোয়া পড়ে আর বিচি গুনে। আপা এসে সব বন্ধ করতে বললেন। স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিলেন এসব করাতে মৃত ব্যক্তির কোন উপকার নেই বরং তিনি আরো কষ্ট পাবেন। কিছু মহিলা দুই একটা কথা বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বিদাতের সাথে কোন আপোষ নাই তার। অতঃপর লাশ গোসল করানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন।

আমি উনার হাজবেন্ড কে নিয়ে বাহিরে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাইয়ের এক চোখ নষ্ট। উনি ইস্পাহানি কোম্পানীর সেলসম্যান। দোকানে দোকানে গিয়ে চা পাতা বিক্রি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় উনার সাইকেল টা লিক হয়ে যায়। বৃষ্টির কারনে কোন সাইকেল মেকার না পাওয়াতে প্রায় ছয় কিলো রাস্তা সাইকেল হাটায় বাড়ি ফিরছেন। সে সময় আমার ফোন পেয়ে আবার স্ত্রীকে নিয়ে তিন কিলো হেটে এসেছেন লাশ গোসল করাতে। রাতের খাওয়াটাও ঠিক মত খেতে পারেননি। অনেক কষ্টে আড়াই শতকের একটা মাথা গোজার ঠাই আছে উনাদের। কিন্তু উনারা নিঃসন্তান দম্পতি। তাই সেই মাথা গোজার ঠাই টুকুও একটা মাদ্রাসাকে দান করে দেওয়ার মৌখিক সম্মতি দিয়ে রেখেছেন।

দোকানে দোকানে চাপাতা বিক্রি করে ভাই প্রতিদিন পান ৩০০ টাকা। কাজে না গেলে কোন টাকা পান না। সন্ধ্যায় কাপড় আয়রণ করার একটা ছোট্ট দোকান দিয়েছিলেন, সেটাও হাউজিং লিমিটেডের জায়গা হওয়ায় কিছুদিন আগে প্রশাসন ভেংগে দিয়েছে। সেটা নিয়ে ভাইয়ের কোন আফসোস নেই। সল্পভাষী মানুষ, মুখে সবসময় হাসি। সন্তান নেই, অর্থকড়ি নেই, এক চোখ নষ্ট তবু চোখ মুখ থেকে সুখের আভা ঠিকরে বের হচ্ছে।

গল্পে গল্পে রাত প্রায় পৌনে দুইটা বেজে গেলো। এমন সময় আপা মৃত বিহারি বুড়ির গোসল কাফন শেষ করে ফিরলেন। টিপটিপ বৃষ্টি তখনো পড়ছে। আবার স্বামী স্ত্রী কে ছাতা মাথায় দিয়ে প্রায় তিন কিলো রাস্তা হেটে বাসায় ফিরতে হবে। আমি মৃত বিহারী বুড়ির পরিবারের লোকদের বললাম পুলিশ লাইনের মার্কেটর পর্যন্ত তাদের একটু এগিয়ে দিতে। শেয়ালের খুব উপদ্রব বাড়ছে। তারা তাদের বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে আবার হাটা শুরু করলো। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো জান্নাতী দম্পতি হেটে যাচ্ছে। আল্লাহ এই দম্পতির ইহকাল ও পরকাল কে মর্যাদাবান করুক। জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন, আমীন।